Skip to toolbar
Categories

শুধু তোমার আমার হৃদয়ে, ভিজে মাটির সোদা গন্ধ

অফিসে আমার ডেস্কটা একেবারে পেছনের দিকে। ইচ্ছে করেই নেয়া। আমি আবার এমিনিতেই সবসময়ই ব্যাক বেঞ্চারস। তবে মজার ব্যাপার হলো আমার সিটের প্রতি কুনজর দেয়া মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম না। আড়াল থাকা একটা ব্যাপারতো বটেই, সাথে প্রকৃতির খুব কাছাকাছিও। 🙂 আজকে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বাইরে তাকিয়ে দেখি মেঘের হাতছানি। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে পুরো ঢাকা শহর। আমি ঠিক জানি না মেঘ বৃষ্টি কিংবা প্রকৃতি নিয়ে আমাদের জেনারেশনের যেমন একটা ফ্যাসিনেশন ছিল কিংবা আছে, এটা পরের প্রজন্মও আপন করে নিচ্ছে কিনা? এমন ঘন কালো মেঘ দেখে আমার যেমন আজকের মুডটাই বদলে গেছে, উড়ু উড়ু মনে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে, রিক্সায় হুড ফেলে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ। দুই হাত টাইটানিকের মতন দুইদিকে ছড়িয়ে দিতে পারলে মন্দ হতো না। তবে ঢাকার রাস্তায় সেটা খুব বুদ্ধিমানের মতন কাজ হবে না। হয়তো দেখা যাবে হাত দুইটা টাইটানিকের মতন ছড়ানোই আছে, সাথে পাও, আর শরীরটা রিক্সার বদলে রাজপথে। 🙂

বৃষ্টি নিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক পোষ্ট লিখব ঠিক করেছি। লিখতে গিয়ে দেখি এর চেয়ে কঠিন কাজ খুব কম আছে। কারন এত এত স্মৃতি, কোনটা ফেলে কোনটা লিখব টাইপ ব্যাপার। একটু ছোট বেলায় চলে যাই শুরুতেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি দেখি এরকম আকাশ, তাহলে হিসেব খুব সোজা। আজ স্কুলে যাব না। তবে বেশির ভাগ সময় কাহিনী যেটা হতো সেটা হলো স্কুলে যাবার সময় আকাশ একদম পরিষ্কার, কয়েকটা ক্লাস যাবার পর ঝুম বৃষ্টি। ব্যস, আরতো ক্লাসে মন বসে না। এর মধ্য দুষ্ট ছেলের দল মাঠে নেমে গেছে ফুটবল নিয়ে। ইচ্ছে করছে এখনি ছুটে গিয়ে একটা স্লিপ মেরে বলটা কেড়ে নিয়ে আসি। 🙁 অবশেষে পুরো ক্লাস একাট্টা হয়ে সিদ্ধান্ত হলো পালাব। যেমন ভাবা তেমন কাজ। হেড মাস্টার আর ক্লাস টিচারের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্লাস পালানোটা একটা ছোট খাট অভিযানের মতন। বয়স কম ছিল বলে প্ল্যানে সবসময় কিছু ফাঁক ফোকর থেকেই যেত। তাই কয়েকজন ধরা পরে যেত। আর থাকত কয়েকটা দুর্বল চিত্তের ভিতুর ডিম। ভয়ে ফিরে যেত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। আমরা যারা পালিয়ে বের হতাম, এর পর আর আগ পিছু কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না। একছুটে ফুটবল মাঠে। মাঠের ঠিক পাশেই ছিল পুকুর। ৫-১০ মিনিট খেলেই এক দৌড়ে পুকুরে একটা লাফ দিয়ে দুইটা ডুব। আবার মাঠে। এই খেলায় কারোই গোল করার প্রতি তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। নিজের চেয়ে অন্যের পায়ে বল গেলেই বেশি আনন্দ লাগত। একটা স্লিপতো মারা যাবেই। 🙂 অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা জেমস বন্ড পাঠাত হেডু। সে এসে মাঠের চারদিকে ঘোরাঘুরি করে দেখতে কে কে খেলছে। নাম গুলো টুকে নিয়ে যেত। আমরা জেমস বন্ডরে তেমন পাত্তা দিতাম না। তবে পরের দিন ক্লাসে কমলা রঙের তিন নাম্বারী বেতকে পাত্তা না দেয়ার প্রশ্নই আসে না। দেড় হাত লম্বা বেত, একটা বাড়ি মারলে তিন দিন থাকত ব্যাথা। আর বেজায়গায় মারলেতো কথাই নাই। 🙁 🙁 🙁

বৃষ্টিটা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি নিঃসন্দেহে সিলেটে। প্রথম বাক্স পেটরা নিয়ে যেদিন গেলাম সেদিন থেকে শুরু। কারনে অকারনে, আভাস, পূর্ভাবাস ছাড়াই অঝরে নেমে আসত। মাঝে মাঝে মনে হতো সিলেটের আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। এত বেশি বেশি পড়ার পড়েও খুব বিরক্ত লেগেছে বৃষ্টিতে এমন মনে পড়ে না। বরং প্রায়ই ঘন্টায় রিক্সা ভাড়া করে হুড খোলা রিক্সায় বেরিয়ে পড়তাম। অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি ভাড়া। এয়ারপোর্ট রোডটা খুব বেশি পছন্দের ছিল। একটা ঘোরা পথ আছে রাগীব রাবেয়া মেডিকেলের পাশ দিয়ে। এই রাস্তায় রিক্সায় চড়ার মজাই আলাদা। এই রাস্তায় যে কত কত স্মৃতি বলে শেষ করা যাবে না। দুর্বলতম মুহুর্ত থেকে শুরু করে হাসতে হাসতে রিক্সা থেকে পরে যাবার ঘটনাও আছে। আর সবচেয়ে কমন কাহিনী হলো তিন বন্ধুর হেরে গলায় বিকট চিৎকার করে গান করা। যা মনে আসে তাই গাওয়া। উঁচু জায়গা গুলোতে রিক্সা টানতে সমস্যা হতো। তখন তিনজন নেমে রিক্সা ঠেলা। মাঝে মাঝে সবাই রিক্সা ছেড়ে হাঁটা। আবার আমাদের মাঝে কেউ একজন শখ করে রিক্সা চালায়।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট থেকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত একটা লম্বা রাস্তা আছে। আমরা বলি এক কিলো। বৃষ্টি নিয়ে আমার সবচেয়ে বেশি স্মৃতি মনে হয় এই রাস্তায়। কোনো বৃষ্টির দিনে এই রাস্তায় হেটে যাওয়া, একতা অন্যরকম ব্যাপার ছিল। রাস্তার দুইপাশ জুড়ে সবুজ গাছের সারি। আর অপ্রাপ্ত বয়স্ক লেক গুলোও বৃষ্টির পানিতে টইটুম্বর। বৃষ্টি থেমে গেলেও গাছের পাতা থেকে টুপ টাপ করে গড়িয়ে পরা পানিগুলো যেন থামতে দিতে চায় না। বৃষ্টির সাথে এদের যেন অন্যরকম আতাত।

হাতে বেশি সময় নেই। আবার ছুটতে হবে কাজ নিয়ে। ছোট একটা ঘটনা বলে শেষ করছি। এইটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে ঘটনা। প্রায়ই খুব মন খারাপ থাকতো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ। বিদায় দিতে হবে এই খুব আপন জায়গাটাকে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আর এত আপন থাকবে না। সবাই বলতো আমার মধ্যে নাকি আবেগ ব্যাপারটা খুব কম ছিল। তবে এই সময়টাতে আমি বুঝতে পারলাম কথাটা আসলে কি পরিমান ভুল ছিল। একটু সুযোগ পেলেই লুকিয়ে কান্নাকাটি করতাম। কোথায় যে এত কষ্ট হতো খুজেই পেতাম না। ওই সময়গুলাতে আমরা কয়েকজন বন্ধু প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে ক্যাম্পাসে আড্ডা দিতাম। যাতে শেষ সময়গুলোর পুরো ব্যবহার হয়। তেমনি একদিন আড্ডা দিতে দিতেই হুট করে বৃষ্টি আসল। আমরা প্রথমে একটু আড়ালে চলে গেলাম। তারপর ২-৩ মিনিটের মধ্যেই সবাই বুঝতে পারলাম, আমরা সবাই আসলে চাইছি বৃষ্টিতে ভিজি। একজন শুধু ইশারা করল। তারপর সবাই একসাথে একটা দৌড় দিলাম মাঝরাস্তায়। ছেলে মেয়েদের দল মিলে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজছে, খুব স্বাভাবিক ব্যাপার না। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বুদ্ধিমানরা হয়তো বুঝতে পারল, ফাইনাল ইয়ার। আমরা অনেকক্ষন বৃষ্টিতে ভিজেছি সেদিন। তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করার পর কেউ কোন কথা বলেনি সেদিন। চেপে থাকা কষ্টটাকে যেন টেনে হিচড়ে বের করে নিয়ে আসল প্রকৃতির কান্না। আমিও বৃষ্টির পানিতে কান্না লুকানোর সুযোগ হাতছাড়া করিনি। আমার বন্ধুদের চোখ দেখে বুঝতে কোনো সমস্যাই হয়নি, ওরাও আমার সাথে আসলে এতদিন লুকোচুরি খেলেছে। বৃষ্টি ভেজা মাটির সোদা মিষ্টি গন্ধটা আসলেই লুকিয়ে থাকে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। আমরা শুধু উপলক্ষ্যের অপেক্ষা করে যাই, সেটার দেখা পাওয়ার।

অঞ্জনের গানটা দিয়েই শেষ করছি।

একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে
থাকবেনা সাথে কোন ছাতা
শুধু দেখা হয়ে যাবে মাঝ রাস্তায়
ভিজে যাবে চটি, জামা মাথা
থাকবেনা রাস্তায় গাড়িঘোড়া
দোকানপাট সব বন্ধ
শুধু তোমার আমার হদৃয়ে
ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ
একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে
মনে পড়ে যাবে সব কথা
কথা দিয়ে কথাটা না রাখা
ফেলে আসা চেনা চেনা ব্যথা
অদূরে কোথাও কোন রেডিওতে
এই পথ যদি না শেষ হয়
আর বৃষ্টির র ংহয়ে যাবে নীল
আর আকাশের রংটা ছাই
একদিন, বৃষ্টিতে একদিন …
ভাঙ্গা দেয়ালের গায়ে সাত পাকে বাঁধা কবে-
কার নুন শো তে কোথাও
আর বৃষ্টির ছাঁটে যাবে না দেখা দুজনের চোখের জল
ছমছম
ছমছম চোখের জল
একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে
আমরা ধরা পড়ে যাব জেনো ঠিক
ধুয়ে যাবে যত আছে অভিমান
ধুয়ে যাবে সিঁদুরের টিপ
আর চটিটাও ছিঁড়ে যাবে তক্ষুনি
তাই পালানো যাবেনা যে কোথাও
রাস্তা যেমন তেমনি
শুধু লোকজন সব উধা

No Comments

Post A Comment