Skip to toolbar
Categories

শিল্পান্তর

পূব আকাশে আলোর রেখা ফুটে উঠেনি। বাতাস জুড়ে এখনো মিহি রাতের গন্ধ। ঝিঝি পোকার ডাক আর ভোরের পাখির মিষ্টি গুঞ্জন ভেদ করেও অনেক দূর থেকে স্পষ্ট শোনা যায় মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি “আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাওম”। আরো কিছু সময় আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছে ওমর। ঠিক সময় মতন উঠে যায় প্রতিদিন। দেরি হয়না কখনো। এই জন্য প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই একবার করে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেয় ওমর। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা রেডি করাই থাকে তার জন্য। মা রাতেই করে রাখেন এই কাজটুকু, যেন এতটুকুও দেরী না হয় ছেলের। মাথায় উলের সাদা টুপিটা দিয়ে, হাল্কা একটু সুগন্ধি আতর মেখে বিসমিল্লাহ বলে মসজিদ পানে রওনা দেয় ওমর।

গত রাতে ঝুপ বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিস্নাত রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে গাছের পাতায় জমে থাকা পানির ফোঁটা এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায় আপন মনে। কাঁদা জমে গেছে মেঠো পথটায়। একটু সরে সরে আলগা পথে হেটে যায় ওমর। টুপটাপ পানির ফোঁটা এসে কাধ চোখ মুখ ভিজিয়ে দিয়ে যায়। রিক্ত মুখে প্রকৃতিকে একটি বারের মতন স্পর্শ করার তাগিদে গাছের পাতায় হাত ছুঁয়ে দিয়েই হাটার গতি বাড়িয়ে দেয় ওমর। সব কিছুর আগে তাকে নামাযটা ধরতে হবে। মসজিদের রাস্তায় পথেই ডান দিকে পড়ে বড় সড় বটগাছটা। বটগাছের আড়ালেই ছোট ছোট খুপরি বানিয়ে তাতেই সাধনা করে সংগীত সাধক দল। এই রাস্তা ধরে এই গাছটার পাশ দিয়েই দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার আসা যাওয়া করতে হয় ওমরের। প্রতিবার তার হাটার গতি একটু কমে যায়। আর হাটতে হাটতেই পেছন ফিরে উকি দিয়ে দেখে। কি যে খোঁজে তার অল্পবয়সী চোখ নিজেও জানে না।

ওমরের পুরা নামটা অনেক বড়। নামের আগে পরে যুক্ত হয়েছে আর কয়েকটা নাম। হুট করে শুনলে বোঝা মুশকিল কয়জনের নাম। গ্রামের ব্যবসায়ী রহিমুদ্দীর একমাত্র ছেলে ওমর। রহিমুদ্দী ব্যবসায়ী হিসেবে যতটা না পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিতি চার চারটা মৃত সন্তানের জনক রহিমুদ্দীর। শেষ মেষ পাশের গ্রামের হুজুর ফজলের পড়া পানি খেয়ে ওমরের জন্মের পর রহিমুদ্দী আর তার বউ অথবা পাঁচ ছেলের নামে এক ছেলে ওমর এর চেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়ে এই গ্রামের প্রধান মোলভী হয়ে যায় ফজল। রহিমুদ্দী পণ করেছিল, ছেলে জীবিত থাকলে তাকে হুজুর ফজলের মাদ্রাসায় পড়াবে। আর এভাবেই জন্মের আগেই ভাগ্য লেখা হয়ে গেল ওমরের, যদিও সুধীজন ভাগ্যে লেখা ছিল বলে সেটা সৃষ্টি কর্তার উপরেই চাপিয়ে দেয় সবসময়ের মতন। এই সব জটিলতা বুঝে উঠার সময় ও পায়নি ওমর। তার আগেই সুরেলা কন্ঠের কোরআন তিলাওয়াত কিংবা আযানের ধ্বনি দিয়ে সে মুগ্ধ করেছে তার আসে পাশের মানুষকে। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ গুরু ফজল। তাই একেবারেই নিজের মতন করে গড়বে বলে সবসময় ওমরের আলাদা যত্ন আত্তি হয় তার মাদ্রাসায়। সবার সাথে পড়তে বসলেও হুজুরের পাশে, সবাই চলে গেলে আলাদা করে একটু বেশি সময় দিয়ে তেলওয়াতে কাজ করা, ধর্মের সাথে সমাজ, জীবন যাপন, নৈতিকতা এসবের সম্পর্ক। প্রতিদিন একটু একটু করে নিজের মধ্য ধারন করা মতান্তর, বিশ্বাস, জ্ঞান আর মূল্যবোধের স্রোত ওমরের ধমনীতে প্রবাহিত করার আপ্রাণ প্রয়াস হুজুর ফজলের। তার দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন ঠিকই নিজের মত করে গড়ে তুলবে ওমরকে। সেই হবে তার পরে এই গ্রামকে ধর্মের প্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার ভবিষ্যত যোদ্ধা।

হুজুরের কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগে ওমরের। কি অদ্ভুত সুন্দর করে সব কিছু ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। ঘুম থেকে উঠার পর থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত ছোট থেকে ছোটতর কাযেও ধর্ম কিভাবে সুন্দর আর পবিত্র জীবনের সন্ধান দেয়। হুজুরের সব কথাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার চেষ্টা করে ওমর। তবে কিছু কিছু ব্যাপারে তার হিসেব মেলে না। যেমন সেদিন হুজুর বললেন শুধু মুসলমানরাই বেহেশতে যাবে, অন্য কোনো ধর্মের মানুষ যত ভাল কাজই করুক, যত দানবীর হোক, যত আদর্শ মানুষই হোক না কেন কোনোদিন বেহেশতে যেতে পারবে না। কিছুতেই তার মাথায় ঢুকে না সেদিন ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নেয়া ফুটফুটে শিশুটার কি হবে? সে কি তাহলে দোযখের আগুনেই পুড়ে মরবে? কিন্ত তার বাপ দাদার ধর্ম ছেড়ে তাকে মুসলিম বানানোর মতন তেমন কঠিন শক্ত কোনো উদাহরন কি আছে তার আসে পাশে? কই ওমরেরতো চোখে পড়ে না। এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেই হুজুর বলেন কিছু কিছু বিষয় নিয়ে অনেক বেশি ভাবতে নেই। শুধু বিষয়টা জানলেই আর মানলেই চলে। মনের ভেতর একটু খচ খচ করে ওমরের, তবুও সে গুরুর কথা মেনে নেয়।

সময়ের সাথে সাথে বয়স একটু একটু করেই বাড়ে ওমরের। অন্য সবার মতই। তবে কঠিনতর গানিতিক সমাজ সংস্কার জ্ঞান তাকে সময়ের চেয়ে একটু দ্রুত এগিয়ে নেয়। তবুও জীবন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল গম্ভীর অভিব্যক্তির অন্তরালে চোখে মুখের সারল্যতা খুঁজে পেতে একটুও কষ্ট হয় না। তাই গুরুর আদেশ উপদেশ সহজাত কৈশোর ধর্মের কাছে চুপচাপ পরাজয় মেনে নেয়, যখন আমরা দেখি ওমরকে উদাশ দৃষ্টিতে মাঠে খেলতে থাকা ছেলেদের তাকিয়ে দেখতে, যাত্রা পালার সূচীর পোষ্টারে আড় চোখে তাকাতে কিংবা মন কেড়ে নেয়া গানের তালে তালে মাথা দোলাতে। ইদানিং পাড়ার মোড়ের ঐ গাতক দলের বাজনা বড্ড যন্ত্রণা করছে। কিছুতেই মন সরানো যায় না। সেদিন প্রায় একটা ঘন্টা কেটে গেছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এর পর যাও টেনে হিচড়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে কিন্তু গানের লাইন গুলো মাথায় ঘুরেছে অনেকটা সময়।

গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।

গানের দলের বৃদ্ধার কন্ঠে এক মায়াবী যাদু আছে। গানের সুরে বুকের মধ্যে কোথায় যেনো একটা মোচড় দিয়ে উঠে। আর একটা নেশা লাগা ঘোর। শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। পোকার মতন মাথায় ঢুকে চিন্তা ভাবনা নিয়ে খেলতে থাকে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় ওমরের। ভয় ভয় অনুভূতি। হুজুর ফজল বলেছেন এইটা শয়তানের কাজ। এই ভালো লাগাটা শয়তান নিয়ন্ত্রন করছে। এই ভালো লাগার মধ্যে অন্যায়বোধ খুঁজতে গিয়ে ওমর শুধু দুইদিকে মাথা নাড়তে থাকে অনবরত। ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে পরিচালিত সকল জাগতিক ভাল চিন্তা মানুষ নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে, আর এটাই তাকে নিয়ে যায় পরকালের চীর শান্তির জগতে। আর অনুশাসন ভুলে, আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে ধর্মকে দূরে ঠেলে নিজের মতন চলার সিদ্ধান্ত গুলো শয়তানের প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সব কঠিন প্রশ্নের উওর এই দুই বাক্যেই সেরে ফেলেন হুজুর ফজল। এই সত্য উপলব্ধি করতে খুব বেশি সময় লাগে না ওমরের। তাই অনেকটা নির্লিপ্ত নির্বিকার ভাবে গানও তার ধমনীতে ঢুকে যায় নামাযের মতই।

সবার অগোচরেই গানের নেশাটা দৈনন্দিন চিন্তা ভাবনায় পরিণত হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন রোজ নিয়ম করে সময় বের করে নেয় সে। ঘোরা পথে একটা রাস্তাও খুঁজে বের করেছে। নদীর কিনার ঘেষে একটু বাকা পথে হেঁটে গেলেই নদীর পাড়ে যে বট গাছটা দেখা যায়, সেখান থেকে গানের দলের আস্তানা খুব কাছেই। শরতের সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে নীল আকাশটা আজ অপূর্ব লাগছে। সাথে নদীর ধার ঘেষা কাশফুল গুলো যেন তুলির আচড়ে আঁকা। এর সাথে একটু কল্পনা করে নিন সেতার- হারমোনিয়াম – তবলা – আর বাশির সমারোহে বট গাছের নিচে গানের দলের জমজমাট সংগীতের আসর। সুর মূর্ছনা থেকে একটু মনোযোগ সরিয়ে আশ পাশে তাকালেই খেয়া ঘাটের মাঝি পবনকে দেখা যায় উদাস মুখে পাড়ে নৌকা ভিড়িয়ে গানের মাঝে বুদ হয়ে আছে। আর এই সবকিছু ছাপিয়ে সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা আর মাথায় সাদা উলের টুপি পড়া ওমরকে দেখে অবাক তাকিয়ে থাকে সকলে। হয়তো অবাক হওয়া এই সকলের সাথে শয়তানও আছে, আর হয়তো আছেন সৃষ্টিকর্তাও। খুব বেশি সময় লাগেনি, কাশবনের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে কাছ থেকে গানের মাঝে নিজেকে হারিয়ে নিয়ে যেতে ওমরের। আর এখান থেকেই সময়টা অনেক দ্রুত এগোতে থাকে। নামায আর কোরআন তিলাওয়াত শেষ করার পর চুপিচুপি গানের কলিগুলোতে সুর বসানো সময়গুলো যেন বাতাসের আগেই ছুটতে লাগলো।

বেশ কিছুদিন ধরে ওমরের মধ্য ছটফট ভাবটা লক্ষ্য করছেন হুজুর ফজল। মুখ ফুটে কিছু বলেননি। অপেক্ষায় ছিলেন কখন ওমর নিজে থেকেই সব বলে। আজ অব্দি এর ব্যতিক্রম হয়নি কখনো। তার পরেও একটু কেমন কেমন লাগছে ভেবে সকালে ওমরকে ছুটি দিয়ে তার পেছন পেছন বের হয়েছিলেন ফজল। আজকের শুক্রবারটা একটু আলাদা অন্য যেকোন দিনের চেয়ে, জুমার দিনে আজ প্রথম বারের মতন আযান দেয়ার কথা ওমরের। আযান দেয়ার আগে তাকে কিছু কথা বলবেন ভেবে রেখেছেন হুজুর ফজল। সেগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে হাটতে থাকেন ফজল। কিন্ত ওমরের গতিপথ তার সমস্ত চিন্তা ভাবনা থামিয়ে দেয়। কেমন যেন অচেনা লাগে তার কাছে এই চিরচেনা পথটা। আসে পাশের লোকজন গ্রামের প্রধান মৌলভীকে এরকম অদ্ভুত পথ ধরে হেটে যেতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঝোপ ঝাড়ের লজ্জ্বাবতী গাছগুলো লজ্জ্বায় চোখ বন্ধ করে ফেলেছে, নির্লজ্জ্ব প্রেম কাঁটাগুলো ফজলের জামা জড়িয়ে জাকিয়ে বসেছে। আর সাদা কাশ ফুলের আড়ালে কারো চোখে পড়েনি, আরো একটা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পড়া প্রতিমূর্তি। আকাশ বাতাস কাপিয়ে ওমরের কন্ঠ দিয়ে বের হয়ে আসছে মিষ্টি মধুর সুর, আর সেই সুরে হুজুর ফজল প্রথমবারের মতন আবিষ্কার করলেন এক অভুতপূর্ব শিল্পান্তর।

হারমোনিয়াম আর বাশির সুরে সুরে স্তব্দ জনপদকে অন্তস্বারশুন্য করে ওমর গাইতে থাকে

আমি অপার হয়ে বসে আছি
ও হে দয়াময়,
পারে লয়ে যাও আমায়।।
আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিল পাটে-
(আমি) তোমা বিনে ঘোর সংকটে
না দেখি উপায়।।
নাই আমার ভজন-সাধন
চিরদিন কুপথে গমন-
নাম শুনেছি পতিত-পাবন
তাইতে দিই দোহাই।।
অগতির না দিলে গতি
ঐ নামে রবে অখ্যাতি-
লালন কয়, অকুলের পতি
কে বলবে তোমায়।।

সেদিনের জুমার আযানটা ওমরই দিয়েছিল। আযানের আগে কিংবা পরে হুজুর ফজল তাকে কিছু বলেছিল কিনা জানা হয়নি আর। শিল্পান্তরের গল্পটা যে শিল্পান্তরে এসেই আমাদের থামিয়ে দিয়ে যায়। আর হয়তো ওমরদের পরিণতি নয়, চিন্তাভাবনাই আমাদের অনেক বেশি ভাবায়।

No Comments

Post A Comment