Skip to toolbar
Categories

শহরের কোনো এক উষ্ণতম দিনে

ঠিক উষ্ণতম বলা যাবে না হয়তো। তবে প্রচন্ড দাবদাহকে উপেক্ষাও করা যাচ্ছে না। স্মৃতিকথন লেখার জন্য একেবারেই উপযুক্ত আবহাওয়া নয়। এডিসন ভাইয়ের আবিষ্কারের সরকারী ডিজিটাইজড ব্যবস্থাপনায় আশা যাওয়ায় লেখালেখি দূরে থাক, একটু প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে থাকাটাই দায়। কি অদ্ভুত, সময় গড়ে দেয় ব্যবধান। একটা সময় এই রকম আবহাওয়ায় খেলার মাঠে কত উচ্ছ্বল সময় কেটেছে। শুধু কি উচ্ছ্বল? বলা ভালো ব্যস্ততম সময়। সেই সময়ের গল্পগুলো এখনো ফ্রেমে বাঁধা। অন্য সব ফ্রেমের সাথে এর তফাত একটাই, সব ফ্রেম চোখ জুড়িয়ে দেখতে, চোখ খোলা রাখতে হয়। আর এই ফ্রেম দেখতে হয় দুচোখ বন্ধ করে। আজ হুট করে সেই সময়ে কেন ফিরে যেতে হলো? আসলে ফিরে গেছি আরো অনেক পেছনে। তবে সব সময়ের মতই গল্পটা কবে থেকে শুরু করবো এই চিন্তায় এবার ছেদ পড়লো সময়ের উত্তাপে।

আমি সব সময় বলি আমার বন্ধু ভাগ্য অসাধারন। হ্যা, আমারো কিছুটা কৃতিত্ব আছে এতে, তবে অসাধারন সব মানুষের বন্ধুত্ব না পেলে জোর গলায় এই কথা বলে বেড়াতে পারতাম না হয়তো। আরো অনেক কিছুর মতই বন্ধুত্ব গড়ে তোলাটা মানুষকে শিখিয়ে দিতে হয় না। কিভাবে কিভাবে যেন অপরিচিত মানুষ গুলোই হয়ে উঠে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোর মাঝে একজন। আজ যার কথা বলছি, সে মোটেও অপরিচিত কেউ ছিল না কখনো। আমাদের পরিচয়টা একেবারে শুরু থেকে। পারিবারিক সম্পর্কের সূত্র ধরে, সে আমার ফুপাত ভাই। ছোট বেলা থেকে কাজিন সম্পর্কে বেড়ে উঠতে উঠতে এক সময় আমরা আবিষ্কার করলাম, আমাদের সম্পর্কটা আসলে শুধু আর কাজিনের নেই। তার চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়, মজবুত, শক্ত এবং হয়ে উঠেছে আস্থার, আশ্রয়ের, প্রত্যাশার। আমরা বুঝতে পারলাম, আমরা আসলে প্রথমে বন্ধু, তারপরে কাজিন। আজো পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় আমি বলি, “ও হচ্ছে ফুয়াদ, আমার বন্ধু। ও আবার সম্পর্কে আমার কাজিনও হয়”। 🙂

আমাদের স্কুল ছিল ভিন্ন। তাই স্কুলের সময়টাতে ঈদের ছুটি গুলোই ছিল সবচেয়ে বড় ভরসার। সেই অল্প সময়ের প্রাপ্তি সম্পর্ক এগিয়ে নেয়াতে কোনো বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেনি। একি ক্লাসে পড়ার কারনে মাঝে মাঝে পড়াশোনার বিষয়টাও অকাতরে হাত বাড়িয়ে বলেছে এগিয়ে চলো বন্ধু। তবে সম্পর্কটা সময়ের চেয়ে ভয়াবহ দ্রুত গতিতে এগিয়েছে কলেজে গিয়ে। যখন আমরা একি কলেজে একি ক্লাসে ভর্তি হই। প্রথম দিন ফুয়াদের ব্যাপক মন খারাপ। আমরা সব বন্ধুরা এক সেকশনে আর সে পড়ে গেল অন্য সেকশনে। পরে মজার ব্যাপার, রোলকলের সময় গিয়ে দেখা গেল স্যার ফুয়াদের রোল আর নাম ধরে ডাকছে। কি অদ্ভুত সেই সময়। বোরিং সব ক্লাস করা, বাংলা ক্লাসে, এক মেয়ের কথা নকল করতে গিয়ে ফুয়াদের ধরা খাওয়া এবং জোর গলায় সেটা অস্বীকার করা, ক্লাসের বিরতিতে কমন রুমের টেবিল টেনিস বোর্ড দখলের লড়াই, সেই লড়াইয়ে হেরে গিয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডের আধভাঙা দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করা। হুট করে ক্যাফে জয়নগর গিয়ে সরিষার তেলে বানানো আলুর চপ আর মালাই চা খাওয়া। দুপুরে সুভাস স্যারের কাছে পদার্থ বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে ঝিমানো, সন্ধায় ইয়াকুব আলি স্যারের বাসায় জৈব রসায়ন লেকচারের কিছুই না বুঝেই হা করে তাকিয়ে থাকা, বাশার স্যারের অনবদ্য গনিত পাঠদান, আর এর মাঝে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট সব বিনোদন কিংবা মিজান ভাই আর তার পার্টনারের কাছ থেকে রসায়ন প্রথম পত্রের দীক্ষা নিতে গিয়ে শুধু হাসতে হাসতেই পার করে দেয়া দুটি বছর। পড়াশোনাটা কেমন করে যেন হয়ে যায়, তবে এর সাথে এত আনন্দ, আজকাল প্রায়ই বেদনা জাগিয়ে যায়, হয়তোবা আনন্দ বেদনার কাব্যটা পুরো করার জন্যই শুধু।

আমার বাসা কলেজ থেকে অনেক দূরে ছিল। প্রায়ই দেখা যেত কলেজের ক্লাস, প্রাইভেট সব ঠিক ঠাক মত করতে গেলে, ভোর ছটায় বাসা থেকে বের হয়ে রাত ১০ টায় ফিরতে হতো। তাই শুধু ঘুমানোর যেই রাত গুলো, সেগুলো আমি রয়ে যেতাম ওদের বাসায়। রাত জেগে আড্ডা, হইচই। মাঝে মাঝে রাতটা অন্য কোনো বন্ধুদের বাসায়, তারপর সবাই মিলে তুমুল হইচই। ছুটির দিন গুলোতে রুটিন ভিন্ন। সারা রাত জেগে ভোর ছটায় ব্যাট বল নিয়ে মাঠে। ভোর বেলার ক্রিকেট খেলার মজাটা এই সময়ের ছেলেরা পায় কিনা আমার জানা নেই। তখনো খুব বেশি ছেলেদের দেখিনি। জমজমাট সব লড়াই খেলার মাঠে। ফুয়াদ আমাদের আক্রমনাত্নক ব্যাটসম্যান আর লেগ ব্রেক অথবা মিডিয়াম পেস বোলার। কাভার ড্রাইভ করতো খুব ভালো। তবে সমস্যা একটাই ও শুধুই কাভার ড্রাইভ করতো আর কিছু করতো না। 🙂 টান টান উত্তেজনার সব খেলা হতো। কখনো কলেজিয়েট স্কুলের ভেতরে, কখনো পেছনে, কখনো পিটিআই স্কুলের ভেতরে। এই খেলা নিয়ে সিরিয়াসনেসের এক বিন্দু ঘাটতি ছিল না। নিজেদের মধ্যেই দল ভাগাভাগি করে খেলাটার জন্য সারারাত না ঘুমিয়ে ভোর ছটায় কিভাবে খেলা সম্ভব আজকাল হিসেব করতে বসলে মেলেনা কিছুতেই।

এর মাঝেই হুট করে একটা হাওয়া বদল আসলো। নাহ, প্রেমের জোয়ার নয় 🙂 । উঠতি বয়সের হাওয়া বদল। টগবগে তারুন্যের রক্তে বিপ্লবের ছোঁয়া। বাম রাজনীতির পোকা ঢুকে পড়লো আমার আরো কয়েকটা বন্ধুর মতন ফুয়াদেরও মাথায়। একসাথে সারাক্ষন থাকতে চাওয়া থেকেই হয়তো প্রায় খানিকটা বাধ্য হয়েই ওদের মিছিল, মিটিং এ আমার উপস্থিতি চোখে পড়ত সবার। একেবার এভাবে বললে ভুল হবে, নীতিগত সমর্থন অবশ্যই ছিল প্রতিটা কর্মকান্ডে। এর মাঝেই কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পানে আমাদের ছুটে চলা। দুইজনের রাস্তা একেবারেই দুই দিকে। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে আমি উদয়ন ট্রেনের দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছি, হাতে ফুয়াদের দেয়া বিভূতিভূষনের উপন্যাস সমগ্র। আড্ডা থেমে নেই তখনো। হুট করে ট্রেনের হুইশেল আর ঝিক ঝিক শব্দ। মনে হচ্ছিল কি যেন একটা ফেলে চলে যাচ্ছি কোথাও। পরের একটা ঘন্টা আমি চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকার চেষ্টা করছি, আর টপ টপ করে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। আরো অনেক অনেক কিছু ফেলে যাওয়ার সাথে ফুয়াদের সাথে প্রতিদিনের আড্ডা দেয়া হবে না আগের মতন, একসাথে পথ চলাটা হয়ে যাবে অনেক বেশি উপলক্ষ্য কেন্দ্রিক। এটাও যে অনেক বড় একটা কারন ছিল সেটা কখনই আলাদা ভাবে বলে হয়ে উঠা হয়নি।

তখন মোবাইল ছিল না। তাই যোগাযোগ হত চিঠির মাধ্যমে। নতুন জায়গায়র নতুন জীবনের মাঝে সময় বের করে আমি চিঠি লিখতাম ফুয়াদকে। ফুয়াদ তার সকল সামর্থ্য দিয়ে জঘন্য সব চিঠি লিখত। যেই চিঠির শুরু হতো “আমি ভালো আছি, মামা ভালো আছে, মামী ভালো আছে, দেবু ভালো আছে, সবাই ভালো আছে “ ইত্যাদি দিয়ে। আর শেষ হতো “তুই ভালো থাকিস, নিজের খেয়াল রাখি” ইত্যাদি দিয়ে। চট্টগ্রাম গিয়ে একবার ওর জঘন্য চিঠির জন্য তিরষ্কার করে আসলাম। পরের বার ফুয়াদ আমাকে একটা চিঠি লিখলো। আমার ঠিক মনে নেই আমি কতবার সেই চিঠি পড়েছি। খুব আহামরি কিছু নেই সেই চিঠিতে, কিন্ত ছিল আমাদের অনেক পাগলামী, অনেক অদ্ভুত খেয়ালী কথাবার্তা। অনেক গুছিয়ে লেখা সেই চিঠিটা ছিল পরিষ্কার ভাবেই আমার তিরষ্কারের উপযুক্ত জবাব।

গল্প বলতে থাকলে সারাদিন সারারাত জাকিয়ে জমিয়ে বলা যাবে। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গিয়ে পরের দিন আবার পুরোদমে শুরু করা যাবে। তবে আজকে হুট করে গল্প বলায় ফিরে যাওয়ার কারনেই বরং ফিরে যাই। নয়তো উপলক্ষ্যটাই হাল্কা হয়ে যাবে রঙিন সময়ের ভিড়ে। তার আগে একটা শেষ কথা। আমি আমার বন্ধুদের উপরে অনেক সময় রাগ করেছি, আবার সেই রাগ নিমিষেই হারিয়ে গেছে। খুব অল্প কয়েকবারই আমি আমার বন্ধুদের উপরে অভিমান করেছি। ফুয়াদের উপরে আমার একবার গভীর অভিমান হয়েছিল। সেই অভিমানে আমি ওর সাথে অনেকদিন কথা বলিনি। কি ভয়াবহ কষ্টদায়ক ছিল ব্যাপারটা, বলে বোঝানো যাবে না। সেই অভিমানের অনুভূতি গুলো কখনই হয়তো প্রকাশিত হবে না। তবে এটা শুদ্ধতম অনুভূতি গুলোর মাঝে একটা।

আজ ফুয়াদের জন্মদিন। আমার ঠিক ১২ দিন আগে পৃথিবীতে আসার জন্য তোকে অভিবাদন ফুয়াদ 🙂 । তোর জন্য অঞ্জনের কটি লাইন।

বন্ধুত্বের হয়না পদবী …
বন্ধুত্বের হয়না তুলনা …
বন্ধুত্ব সবুজ চিরদিন …
বন্ধুত্বের বয়স বাড়েনা …

No Comments

Post A Comment