Skip to toolbar
Categories

বিজনেস

রাত ন’টা বাজে। এমন কিছু বেশি রাত হয়ে যায়নি। কিন্ত রাস্তা ঘাট একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। শীতকালের হিসেব গুলোই এমন। রাতটা খুব দ্রুত গভীর হয়ে যায়। আর ভোরটা অনেক দেরিতে দেখা দেয়। চারপাশে প্রচন্ড কুয়াশা। কনকনে ঠান্ডা পড়েছে এবার। যাকে বলে একেবারে হাঁড় কাঁপুনী ঠান্ডা। কি জানি, হয়তো প্রতিবার একি কথা মনে হয়। যখন অনেক ঠান্ডা পরে তখন মনে হয় এবারই বুঝি সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়ছে। তবে আজ কুয়াশা পড়েছে প্রচন্ড। এক মিটার সামনে কি আছে তাও দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারে এমন ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে। রেল স্টেশনের একেবারে কাছে এসে পড়েছি। রাস্তা ঘাট জনশুন্য হতে পারে। রেল স্টেশন কিন্ত সদা প্রাণ চঞ্চল। ঝাল মুড়ি, ঠান্ডা পানি, চা…গরম চা, সিদ্ধ ডিম, আগামী কালের পত্রিকা………একেবারে সরগরম স্টেশন।

আজকাল রেল স্টেশন গুলো অনেক সুন্দর হয়ে গেছে দেখে মনে হয় এয়ারপোর্ট। বড় ডিজিটাল একটা বোর্ড আছে। সেখানে সব ট্রেনের সময় সূচী দেখা যায়। একটা বড় ডিজিটাল ঘড়ি আছে যেটা সারাক্ষন সবাইকে তটস্থ করে রাখছে। কিছুক্ষন পর পর একটা মিষ্টি সুর সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে “……..নিন্মগামী চারুলতা এক্সপ্রেস ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যেতে কিছুটা বিলম্ব হবে। অতএব যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারা ধৈর্য্য সহকারে বিশ্রামাগারে অপেক্ষা করুন। ” আমি অবশ্য বিশ্রামাগারে বসে নেই। ঘুরে বেড়াতেই আমি বেশি পছন্দ করি। স্টেশনের মানুষ দেখি। মানুষ দেখা একটা বিশাল বিনোদন। অন্তত আমার কাছে ব্যাপারটা সেরকমই। মানুষের চলা ফেরায় একটা ছন্দ আছে। সেটা আলাদা করাটা বোধয় একটু কঠিন। এক এক জন এক এক দিকে ছুটছে। হয়তো কারো সাথে কারো গন্তব্যের কোনো মিল নেই। কিংবা মিল থাকলেও কারো সেটা জানা নেই। জানার প্রয়োজনও নেই। সবাই শুধু ছুটছে আর ছুটছে।

ঠিক এই মুহুর্তে যেই মানুষটাকে চোখে পড়ছে পাতলা লিকলিকে ধরনের। কিছুটা বিরক্ত হয়ে আছে। সম্ভবত টিকিট জনিত ঝামেলায় পড়েছে। কাউণ্টারে অনেক অনুনয় বিনয় করেও বোধয় কোনো লাভ হয়নি। মোবাইলে কাকে জেনো চিৎকার করে বলছে টিকিট না পাওয়ার কথাটা। ভদ্রলোক কি অনেকদিন দেশের বাইরে ছিল? নাকি অনেকদিন পর ট্রেনে যাতায়াত করছে? অন্য যে কেউ হলে এখন আসে পাশে টিকিট খুঁজতে শুরু করে দিত। খুব একটা কঠিন কাজ নয়। ব্ল্যাকারদের অভাব নেই এখানে। তাছাড়া কাউন্টারে একটু টাকা পয়সা দিলে কপাল খুব খারাপ না হলে একটা টিকিট ম্যানেজ হয়ে যাবার কথা। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম তেমন কাউকে দেখা যায় কিনা। নাহ্‌ চোখে পড়ছে না। এই লোকের সমস্যা ও নিজেই সমাধান করবে, আমার এত তাড়া কিসের? তার চেয়ে বরং চা বিক্রেতা খুঁজে বের করা দরকার। লেবু দিয়ে লীকার চা খেতে হবে এখন। সামান্য দারচিনি আর এলাচ থাকলে আরো ভালো হতো। এখানে এতটা আশা করা অন্যায় হয়ে যাবে জানি। তারপরো ইচ্ছেতো আর পুরোপুরি চাপা দিয়ে রাখা যায় না। ওই যে, একজনকে দেখা যাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম তার দিকে।


“ এক কাপ চা দেয়া যাবে?”


“ আপনি যদি পয়সা দেন তয় এক কাপ কেন আমার কাছে যত চা আছে সব দিয়া দিমু।”


“সব দিতে হবে না। আপাতত এক কাপ চা দাও। ”


তার পুটলি গুলোতে উকি দিয়ে দেখলাম। সব না হলেও অন্তত লেবু আর আদা যে পাওয়া যাচ্ছে এটা নিশ্চিত। ঠান্ডায় হাত মোটামুটি জমে যাচ্ছে। গ্লাভস থাকলে আরেকটু আরাম পাওয়া যেত। হাত দুটো ঘষে ফুঁ দিয়ে একটু গরম করে নিলাম। আমি প্রায় পুরোপুরি প্যাকেট হয়ে আছি। আমার পরিচিত কেউ দেখলেও বুঝতে পারবে না এটা আমি। জিন্স, ফুলহাতা টিশার্ট এর উপর কালো জ্যাকেট, একটা কান টুপি, গলায় একটা উলের মাফলার প্যাঁচানো, আর সব কিছুর পর গায়ে একটা চাঁদর জড়ানো। ধুসর রঙের। সাদা আর কালো এই দুটো রঙ আর এই দুটোর মিশ্রনে যা যা রঙ হতে পারে, কেমন যেন বড় কাছের মনে হয়। আমাদের জীবনটা বড় বেশি সাদা কালো বলেই হয়তোবা।


“আরেক কাপ চা দাও। তোমার চা টা ভালো হয়েছে। ”


“ আমার চায়ের দাম কিন্তু পাঁচ টাকা। আপনের যদি চা ভালো নাও লাগে পরে দাম নিয়া কোনো কথা কইতে পারবেন না কিন্তু কইয়া দিলাম।”


আমি অবাক হয়ে লোকটাকে দেখতে লাগলাম। মনে হচ্ছে সে দুনিয়ার সব মানুষের উপরই বিরক্ত। বিড় বিড় করে কি যেনো বলছে। মনে হয় যারা তার চায়ের পাঁচ টাকা দাম নিয়ে কথা বলেছে তাদেরই গালি গালাজ করছে।


“ভাই টিকিট লাগবো? চারুলতার টিকিট? মাত্র ২২০ ট্যাকা।”


আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। অল্প বয়সি একটা ছেলে। কেবল মাত্র নাকের নিচে গোফের রেখা দেখা দিতে শুরু করেছে। গায়ের রঙ ময়লা। চুল গুলো নারকেল তেল দিয়ে চুবিয়ে আঁচড়ানো হয়েছে। খুব আনন্দ নিয়ে পান চিবুচ্ছে। হঠাৎ ওই লোকের কথা মনে পড়লো। কে জানে টিকিট পেয়েছে কিনা এখনো। একটা কাজ করলে কেমন হয়? লোকটাকে একটা টিকিট দিয়ে ভড়কে দিলে?


“২২০ টাকা? কম হবে না?”


“নাহ্‌ ভাই। এর কমে হইব না। নিলে নেন, না নিলে নাই।” বলেই পানের পিক ফেললো সে।


“তুমি এতটা নিশ্চিত হলে কেমনে যে তুমি আরেকজন প্যাসেঞ্জার পাবাই? তোমার টিকিটতো নাও বিক্রি হতে পারে। আর কোনো কাস্টমার তুমি নাও পেতে পারো তাই না।”


“এত কথার কাম নাই। যা কইলাম তাই শেষ। আমার লস হইলে আমি বুঝমু। হেইটা নিয়ে আপনের মাথা না ঘামাইলেও চলবো। ”


“আচ্ছা মানলাম। কিন্ত একটা কথা বল। টিকিটটা যদি বিক্রি না হয় তখন তুমি কি করবা? ”


“এইটা হইল বিজনেস। সব কথা কইতে নাই। আমি আপনেরে শিখায়া দিলাম, আর কাইল আপনেও মাঠে নাইমা পড়লেন। তখন আমার পেটে লাথ্‌থি। বুঝচ্ছি আপনে টিকিট কিনবেন না। যাগো টিকিট লাগে হেরা এত কথা কয় না।”


“শোন। দাও টিকিট দাও। ২২০ টাকাই দিব।”


ছেলেটার মুখে বিজয়ের হাসি। এতক্ষনে হঠাৎ খেয়াল করলাম। গায়ের রংটা কালো হলেও, ছেলেটার চেহারা মিষ্টি। হাসিটা অনেক সুন্দর। একটা সরলতার ছাপ আছে তার চোখে মুখে। ছেলেটার হাত থেকে টিকিটটা নিয়েই আমি হাঁটা দিলাম। ছেলেটা ভ্যাবচেকা খেয়ে গেল। আমার পেছন পেছন আসতে লাগলো। আর চিৎকার করে বলতে লাগলো


“আরে ভাই আমার ট্যাকা না দিয়া কই জান আপনে? আরে ও ভাই, ট্যাকা দিয়া যান। ”


আমি ওর কথায় কান দিলাম না। বুঝতে পারছি সে আমার পেছন পেছন আসছে। আমি খুঁজছি সেই পাতলা মতন লোকটাকে। ছেলেটা আমার একেবারে কাছে এসে দাড়িয়েছে। আমি ওর দিকে ঘুরলাম। চোখ মুখ শক্ত করে বললাম


“চুপ। একেবারে চুপ। ”


ধমকে কাজ হলো। সে খানিকটা ভয় পেল। নরম সুরে বলল


“ভাইজান আপনে কি পুলিশ? আমি আপনের কি ক্ষতি করলাম? আমার সাথে এমুন করেন কেন? হয় আমার ট্যাকাটা দেন, নয়তো টিকিটটা দিয়া দেন। আমি এইখান থেকে ফুট দিই। ”


ওই যে লোকটাকে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছেনা সে এখনো টিকিট পেয়েছে। টিটি’র সাথে কথা বলছে কি নিয়ে যেন। টিটি হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছে তার কথা। আমি এগিয়ে গেলাম তার দিকে। ছেলেটা আমার পাশে পাশে আসছে। আমি মাফলারটা আরেকটু পেচিয়ে নিলাম গলায়। কান টুপিটা ঠিক করে নিলাম। চাঁদরটাও জড়িয়ে নিলাম আরেকবার। ছেলেটা খুব অস্বস্তি বোধ করছে। ওর চেহারায় ওই ঝলকটা আর নেই। যেটা ক্ষানিক আগেই আমাকে মুগ্ধ করেছিল।


“ভাইজান একটু শোনেন।”


“আমাকে বলছেন? ”


“জ্বী, আপনেরেই বলতেছি। ”


লোকটা এগিয়ে এলো আমার দিকে।


“আপনেরতো চারুলতার একটা টিকিট দরকার তাই না? ”


“হ্যাঁ, কিন্ত আপনি জানলেন কিভাবে।”


“ সেইটা জরুরী না। আপনার দরকার টিকিট কেনার আর আমার দরকার বিক্রি করার। আপনে এইটা বুঝবেন না আমি কিভাবে বুঝলাম। যাই হোক এত কথার কাজ নাই। আমার কাছে একটা চারুলতার টিকিট আছে। আপনে নেবেন? ”


“কত দিতে হবে বলেন? ”


“বেশি না। মাত্র ২৫০ টাকা। অন্য সময় হইলে আরো বেশি নিতাম। আপনের জন্য আজ একটু ছাড়।”


এটা বলেই আড় চোখে একবার ছেলেটার দিকে তাকালাম। সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। একেবারে সেই রকম বিজয়ের হাসি। ওই লোককে বিদায় করে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম ওই ছেলের দিকে গুনে গুনে ২২০ টাকা দিলাম। ছেলেটার মুখ একেবারে চুপসে গেছে। মনে হচ্ছে এমন অভিজ্ঞতা ওর আগে হয়নি। সে একেবারে মন মরা হয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি পেছন থেকে ডাক দিলাম।


“এই ছেলে, শোন।”


ছেলেটা পেছন ফিরে তাকালো।


“কি নাম তোমার?”


“জাহাঙ্গীর।”


“কাছে আস।”


ছেলেটা এগিয়ে এল।


“আমার উপর রাগ করেছ? ”


ছেলেটা দুই দিকে মাথা ঝাকালো দুই দিকে। যার অর্থ হলো না।


“নাও এই টাকাটা রাখো। ”


“নাহ্‌। ওইডা আমার ট্যাকা না। ওইডা আপনের ট্যাকা। আমি নিমু না।”


বলেই সে এক সেকেন্ডও দাড়ালো না। হন হন করে হেঁটে চলে গেলো। বোধহয় কাস্টমার খুঁজতে গেছে। আমার মনে হলো মনস্তাত্তিক এই খেলায় শেষ পর্যন্ত আমি হেরেই গেলাম ছেলেটার কাছে। একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে এল। মিষ্টি কন্ঠটা আবার কি যেনো বলছে “……চারুলতা এক্সপ্রেস ৪ নাম্বার প্লাটফর্মে দাঁড়ানো আছে…… ”

No Comments

Post A Comment