Skip to toolbar
Categories

ফ্লপ শো: জনতা এক্সপ্রেস (শেষ পর্ব)


খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠল রজত। আজকে সারাদিন তার অনেক কাজ। ঘড়ি ধরে কাজ করার স্বভাব তার অনেক পুরোনো। এই জন্য শখের ঘুমের উপর একটা ভয়ানক নিয়ন্ত্রন আনতে হয়েছে। আজকে একটু ঝামেলা হয়ে গেল। অফিসে যাবার কোনো প্ল্যান ছিল না তার। সেই হিসেব করে সে তার পুরো দিনের কাজের প্ল্যান করেছে। কিন্ত কাল রাতে মামুন ভাই ফোন করে আজকে অবশ্যই অফিসে যেতে বললেন। জরুরী কাজ আছে বলেও পার পায়নি রজত। বেশ ঝামেলাই হয়ে গেল আজ। অনেক কাজ জমে গেছে। অফিসের কাউকে আসলে বলা হয়নি। বেশ কিছুদিন ধরেই একটা ডকুমেন্টরি নিয়ে কাজ শুরু করেছে রজত। এই কাজ করতে গিয়েই তার মাথায় শো এর আইডিয়াটা আসে। যখন মামুন ভাই রাজী হয়ে গেলেন তখন ডকুমেন্টরির পাশাপাশি সময় করে শো এর কাজ চালিয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক হলো পুরোদমে ডকুমেন্টারির কাজ শুরু হয়েছে। সে নিজেই ভাবছিল কদিন শো এর কাজ বন্ধ রাখবে। কিন্ত বলবে বলবে করেও সেটা আর বলা হলো না। কষ্টটা তাকে আর করতেও হয়নি। তবে তার খুব ইচ্ছে ছিল আগামী পর্বটা করেই শেষ করার। কিছু কথা বলা বাকি ছিল তার।একটা সুযোগ পেলে মন্দ হতো না। তবে গত রাতে মামুন ভাইয়ের ফোন পেয়েই মোটামুটি ধরেই নিয়েছে এটা আর হচ্ছে না। গত এক সপ্তাহে সে নিজেকে অনেক গুছিয়ে নিয়েছে এই ব্যাপারটাতে। আসলে কোনো একটা কিছুর সাথে একটু বেশি সময় জড়িয়ে গেলেই তার শিকড় গজিয়ে যায়। খুব দ্রুত সব কিছুকে আপন করে নেয়ার সহজাত স্বভাব। খারাপতো লাগেই। সব ভুলে নিজের কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলো রজত।

টেবিলে সব কিছু গোছানোই ছিল। রাতে ঘুমানোর আগে সব গুছিয়ে রেখেছে। আরেকবার দেখে নিল। ব্যাগটা কাধে নিয়ে ঘুরতেই চোখে পড়ল ডায়রীটা। মনে মনে একটু হাসল রজত। এটা কেমন করে ভুলে গেল আজ? এটা ছাড়াতো তার কাজই সম্ভব না।অনেক পুরোনো হয়ে গেলেও ডায়রীটা দেখতে বেশ চমৎকার।কাভার পেইজে খোদাই করে লেখা 1999। গতকাল রাতে আরো একবার ডায়রীটা পড়ল রজত। কয়দিন পর পরই পড়ে। এই ডায়রীর প্রতিটা পাতা জুড়েই যেন তার অস্তিত্ব। মাঝে মাঝে সে ভাবে স্টিভ যদি এই ডায়রীটা তাকে না দিয়ে যেত তাহলে? একেবারেই অন্যরকম হতো তার জীবনটা। জীবনদর্শন তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। সে বেড়ে উঠেছে একটা ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায়। অন্য এক দুনিয়াতে। অথচ এই একটা ডায়রীর কিছু মলিন স্বচ্ছ পৃষ্টার অজানা কিছু কথা তাকে দাড় করায় অন্যরকম এক বাস্তবতার মুখোমুখি। প্রায় রাতে সে একবার করে ধন্যবাদ দেয় স্টিভকে। স্টিভের সাথে অনেকবার এদেশে এসেছিল রজত। অনেক আনন্দ নিয়ে কাজ করেছে প্রতিবার। ঘুরে বেড়িয়েছে, এই দেশের অনেক ব্যাপার স্যাপার তার কাছে অদ্ভুত ঠেকতো। আর খুব বেশি অদ্ভুত লাগতো স্টিভকে দেখতে। এত দূরের এই ছোট, সমস্যায় জর্জরিত একটা দেশের জন্য তার আবেগের ব্যাপারটা যে কারো কাছেই অদ্ভুত লাগার মতন ছিল। শেষবার যখন এদেশে পা রাখে রজত, আর ফিরে যায়নি। স্টিভের অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা বুকে নিয়ে আর নতুন ভাবে নিজেকে খুঁজে ফিরে রয়ে যায় এখানে। মাঝে মাঝে স্টিভের কথা খুব মনে পড়ে তার। নয় বছর, একেবারে কম সময় নয়। ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে। আজকে তার অনেক কাজ। ডকুমেন্টরীর খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। দুইজন মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। শুটিং এর ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। কোনো ভাবেই দেরী করার কোনো সুযোগ নেই।

“আরে রজত, আসো আসো। উফ কি যে ঝামেলায় আছি।”

“কেন মামুন ভাই,আবার কি হইল?”

“আর কইও না। বহুত ঝামেলার মইধ্যে আছি। এই বেটা প্রোগ্রাম ডিরেক্টর আমার মাথা খাইয়া ফালাইতাছে।”

“তার সাথে আবার কি হইল?”

“কি আর? ওই পুরানা প্যাচাল। সে তোমার একটা সিভি চাইছে। তোমার নাকি ইন্টারভিউ নিবে। ফাজলামোর আর জায়গা পায় না। কি আমার প্রোগ্রাম তার লাইগা আবার ইন্টারভিউ। শালা। তুমি একটা কাজ করো। এই ফর্মটা ফিলাপ কইরা দাও। ঠিক মতন লেখবা। তোমার সেই আয়ারল্যান্ডের পত্রিকায় যে কাম করতা? ওইটার ডিটেইলস লেখবা। আর লন্ডনে যেইখানে পড়ছ সেইটা বড় কইরা লেখবা। যাতে বেটার চোখ টা টা করে। আর বেটা ডাকলে একদিন দেখা কইরা শুইনা আইসো। হইয়া যাবে আশা করি। প্রোগ্রামের নাম ভালোবাসার এপিঠ ওপিঠ।”

“বাহ ভালো নাম হইছে। প্রোগ্রামটা কি আগামী মঙ্গলবার থেকেই শুরু হইতেছে মামুন ভাই?”

“ইয়ে, রজত। কিছু মনে কইর না ভাই। আমি অনেক চেষ্টা করছিলাম। কিন্ত তোমারে দেয়া কথাটা রাখতে পারি নাই। এই প্রোগ্রামটা আগামী মঙ্গলবার থেকেই শুরু হবে। তবে তুমিতো থাকতাছ।”

“ও আচ্ছা।”

“আরে মিয়া আপসেট হইতাছ কেন?”

“না না। আমি আপসেট না।”

“কইলেই হইল? চেহারা দেখলেই বুঝা যায়। আরে আপসেট হইও না। আর এমনতো না যে তুমি থাকতাছ না। ধইরা নাও তুমি হইলা ফিল্ডার। তোমার ফিল্ড পজিশন চেঞ্জ হইছে, আর কিছু না।”

“হা হা হা, ভাল বলছেন মামুন ভাই। এই জন্যই আপনারে আমার এত ভালো লাগে। মামুন ভাই আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”

“কইয়া ফালাও। আমার হাতে বেশি সময় নাই।”

শুনে মনে মনে একটু খুশিই হলো রজত। খুব বেশি সময় নিল না সে।

“শুনে খুব ভালোই লাগলো রজত। আবার একটু খারাপও লাগতেছে তুমি আর থাকবা না এইটা ভাইবা। তুমি হয়তো জানো না, তোমারে আমি অনেক পছন্দ করি।”

“আপ্নাকেও অনেক ধন্যবাদ মামুন ভাই। আমার জন্য অনেক করছেন আপনি।”

“তা তোমার ডকুমেন্টরিটা কিসের উপ্রে?”

“কয়েকটা বানানোর চিন্তা ভাবনা আছে। তবে ঠিক এখন যেটা নিয়ে কাজ করতেছি সেইটা হইল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যত বীরঙ্গণা ছিল, তারা ও তাদের সেইসব ওয়ার চাইল্ডদের এখন কি অবস্থা? সামাজিক, অর্থনৈতিক। এসব নিয়া।”

“তুমি কি কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নিয়া করতেছ??”

“হ্যা। নেত্রোকোণার একটা গ্রাম নিয়া শুরু করছি। ওইখানে একটা বিশাল ক্যাম্প ছিল? ওইটা নিয়াই আপাতত কাজ করতেছি।”

“আমি একদিন সময় কইরা যামুনি তোমার শুটিং দেখতে।”

“মোস্ট ওয়েল্কাম মামুন ভাই”

অফিস থেকে বিদায় নিয়েই রওনা হয়ে গেল রজত। স্পটে পৌছুতে লেগে যাবে প্রায় ঘন্টা দুয়েক। গাড়িতে উঠেই স্ক্রিপ্টের খাতাটা খুলে বসলো। আজ মরিয়ম আর সালমা নামে দুজন মহিলার সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা আছে। অনেক কষ্টে এদের রাজী করানো গেছে কথা বলার ব্যাপারে। কেউই ক্যামেরার সামনে কিছু বলতে রাজী হয় না সামাজিক ভাবে হেয় হবার ভয়ে। মাঝে মাঝে রজতের অবাক লাগে, এদেরও হেয় হতে হয়। মরিয়ম নামে ভদ্র মহিলার একটা মেয়ে হয়েছিল যুদ্ধের পরে। সেই মেয়ের বার বার এই কারনে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়াতে, এক সময় মেয়েটা গলায় দড়ি দিয়ে আত্নহত্যা করে। সালমা চোখ মুছতে মুছতে বলে তার ছেলেটাকে সে মেরে ফেলেছিল নিজ হাতে। কারন প্রতি রাতে ঘুমানোর সময় নাকি সে ছেলেটার গায়ের থেকে ওই পাশবিক গন্ধটা পেত। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী ঝাপসা চোখে তার বউয়ের আত্নহত্যার গল্প বলে। কেরামত মিয়া শেষ পর্যন্ত তার মেয়ের লাশটাই খুঁজে পায়নাই। এরকম আরো অসংখ্য গল্প উঠে আসবে এই তথ্যচিত্রে। এসব ভাবতে ভাবতে গা গুলিয়ে উঠে রজতের। রক্তকণার মধ্যে এক অদ্ভুত আলোড়ন টের পায় সে। গ্রামের যেখানটায় ক্যাম্পটা ছিল, সেখানে গেলে সে যেন শুনতে পায় গগন বিদারী চিৎকার। সম্ভ্রমহানীর লজ্জা মাখা এক অনুভূতি। পাশবিকতার চুড়ান্ত স্পর্শ। নদীর পাশ দিয়ে হেটে গেলেই সারাক্ষন তার চোখে পড়ে শাড়ী প্যাচানো একটা লাশ ভেসে আছে। স্টিভ সবসময় বলতো সে খুব আবেগী। সে বেঁচে থাকলে আজ অনেক খুশি হতো হয়তো। একটু অবাকও কি হতো না? এত আবেগী মানুষটা হতে পারত স্তম্ভিত। হুট করে এই বয়সে এসে যখন সে জানতে পারে এটাই তার জন্মভূমি একটু কি অভিমানী হতে পারতো না? সব আবেগকে ছাড়িয়ে সে মন প্রাণ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবার। তার খুব ইচ্ছা ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে এটার কাজ শেষ করবে। তবে হাতে সময় খুব কম। অনেক কাজ বাকী এখনো। গাড়ির মৃদু ঝাঁকিতে তন্দ্রা ভাব আসে রজতের। ডায়রীটা আকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। আর তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে, শেষ পর্বের ঠিক করা কথাগুলো বলা হলো না আর। জনতা এক্সপ্রেসের অন্য সব অতিথির মতন করে একজন জনতা হয়ে তার আসা হলো না। পছন্দের কয়েকটা গান সিলেক্ট করে রেখেছিল অনুরোধ করবে বলে। শোনা হলো না। কেউ জানলো না তার গল্প। সে সকলের কাছে রয়ে গেল ফ্লপ শো জনতা এক্সপ্রেসের অযোগ্য আর জে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ করেই যেন আর সব সময়ের মতন করে তার পিঠে হাত রাখলো স্টিভ।

আর মৃদু হেসে বলে উঠল,

“মাই চাইল্ড, ডোন্ট ওরি। এভরিথিং উইল বি আল রাইট। “

ঘুম লাগা চোখের সে বলে উঠে

“থ্যাঙ্কস স্টিভ।”

ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে “কার লগে কথা কন স্যার?”

“নাহ কিছু না, তুমি গাড়ি চালাও।”

বিঃদ্রঃ ১৯৯৬ সালে লন্ডনের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বছর শেষের সাময়িকীতে উদীয়মান ক্যাটাগরীতে সাংবাদিকতা বিভাগের রোজেত ডসন নামে আয়ারল্যান্ড বংশোদ্ভুত একজন ছাত্রের বায়োগ্রাফী ছাপা হয়। সেখানে তার মেন্টরের নাম হিসেবে ছিল বিখ্যাত সাংবাদিক স্টিভ ডসন। মেন্টরের সাথে তার সম্পর্কের কলামে লেখা ছিল পিতা-পুত্র। তবে রোজেতের চেহারাতে এশিয় ধাঁচ অনেক বেশি। অনেক খোঁজ করেও রোজেতের মায়ের ব্যাপারে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি।
(শেষ)

No Comments

Post A Comment