Skip to toolbar
Categories

ফ্লপ শো: জনতা এক্সপ্রেস (পর্ব – ১)

প্রতিদিন অফিসে ঢুকেই রজত প্রথমে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারটায়। একটা স্মিত তৃপ্তির হাসি দেয় রজত। তার সময় শুরু হবে একটায়। সে প্রতিদিন এক ঘন্টা আগে আসে।একটা নামকরা রেডিও চ্যানেলে কাজ করে রজত। প্রতি মঙ্গলবার রাত একটায় ২ ঘন্টার একটা শো। শো নিয়ে শেষ মুহুর্তে কিছু কাজ করে এই ঘন্টা জুড়ে। এই শো এর কাজ পেতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কেউ এমন একটা শো এর স্পন্সর করতে রাজী হচ্ছিল না। যেখানেই গিয়েছে সবাই বলেছে এটা একটা নিশ্চিত ফ্লপ শো। জেনে শুনে কেউ একটা ফ্লপ শোতে ইনভেস্ট করতে রাজী না। তারপর অনেক কষ্টে মামুন ভাইকে ম্যানেজ করতে পেরেছিল। কাজটা দেবার সময় মামুন ভাই বলেছিলেন তিনি জেনে শুনে বিষ পান করছেন। শুনে অনেক কষ্ট লাগলেও কাজটা শুরু করতে পারার আনন্দে বিভোর হয়ে এসবকে উড়িয়ে দিয়েছিল রজত। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সবার অনুমান সত্যি প্রমান করে চুড়ান্ত ফ্লপ শো হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায় সব মহলে। তাই শুরুর দিকে সকাল ৯টায় থাকলেও আস্তে আস্তে শো টাইম চলে আসে রাত দুইটায়। আর সব শেষে গতমাসে মামুন ভাই তাকে ডেকে নিয়ে বলে এটাই এই শো এর শেষ মাস। কোনো কথা না বলে কিছুক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে রজত।

অল্প কিছু নীরবতার পর মামুন ভাই বলেন
“আই এম স্যরি রজত, কিন্ত আমার আর কিছু করার নাই। আর আমার মনে হয় যথেষ্ট হয়েছে। তুমি একটা কিছু চেষ্টা করেছ, আইডিয়া আমার কাছে একেবারে মন্দ মনে হয় নাই। তাই আমি বাজীটা খেলছি। কিন্ত পাবলিক না খাইলেতো আর একটা জিনিষ টানা যায় না তাই না? তোমারে আমি অনেক পছন্দ করি রজত। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হইলে এই শো এতদিন চালাইতে দিতাম না।”

রজতের একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। বন্দুকের গুলি চালানোর মতন। সে তখন সেইটা করে একটা হাসি দিয়ে বলে

“ম্যানি থ্যাঙ্কস মামুন ভাই।”

মনে মনে অনেক কষ্ট হতে থাকে তার। এই শো তার নিজের সন্তানের মতন। প্রতিটা পর্বের পেছনে সে অনেক সময় দিয়েছে। সে যা চেয়েছে তাই বের করে এনেছে। কিন্তু হলো ন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, ক্লান্তির, হতাশার আর কিছুটা হয়তো পরাজয়েরও বটে। অফিসে ঢুকেই নিজের ডেস্কে গিয়ে সামনে রাখা ফাইল্টা খুলে বসল। মোটামুটি সব হোমওয়ার্ক করাই আছে। তাও আরেকবার গুছিয়ে নিতে হবে। ছেলে বেলা থেকেই রজত খুব ভালো করে জানে, সে মেধাবী নয়। তাকে আর সবার চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করেই যেকোনো কিছু অতিক্রম করতে হয়েছে। যেটা অন্য সকলের ৫ বার পড়লেই হত সেটা তার কমছে কম ১০ বারতো অন্তত পড়তে হত। ছেলেবেলার সেই দূর্বলতা এখনো যায়নি তার।

“রজত ভাই”

“আরে শফিক তুমি এখনো অফিসে?”

“শুধু আমি না রজত ভাই, আজকে আরো অনেকেই আছেন। সেই আলাপ পরে হবে, আপাতত মামুন ভাই আপনাকে ডাকছেন। যান গিয়ে দেখা করে আসুন।”

“মামুন ভাই? এত রাতে?”

“হমম, ওনার কি যেন কাজ আছে।”

কি সব আকিবুকি নিয়ে ব্যস্ত মামুন ভাই। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় রজত। আর প্রস্ততি নিতে থাকে মানসিক ভাবে। সে জানে আজকেও অনেক কথা শুনতে হবে। আজকের পর আর একটা শো হাতে থাকার কথা হিসেব অনুযায়ী। আদৌ সেটা করতে পারে কিনা? নাকি মাঠের বাইরেই অবসরে যেতে হবে? ইশ যদি আজকের শো টাই শেষ হয় তাহলে একটা আফসোস থেকে যাবে তার। শেষ শোটাতে একটা চমক দেবার খুব ইচ্ছে ছিল তার। অবশ্য হয়তো সে নিজেই ভাবছে এটা চমক। পরে দেখা যাবে এই পর্বই হবে সবচেয়ে ফ্লপ।

“আরে মিয়া দাঁড়ায় আছ কেন? বসো। তোমার খবর কি? আছ কেমন?”

“ভাল আছি মামুন ভাই।”

“আজকে তোমার শো এর গেস্ট কই? আসে নাই এখনো?”

“এখনো আসে নাই, চলে আসবে একটু পরেই।”

“তোমার গেস্ট গুলানতো আবার অনেক স্পেশাল হয়। কইত্তে যে পাও তুমি এইসব মানুষরে? সত্য কথা বলতে কি রজত, আমার কিন্ত তোমার শো টা অনেক ভালো লাগে। সেইদিন যে একজন অবসরপ্রাপ্ত লোকরে নিয়া আসছিলা? খুব ভালো লাগছে। মজাও লাগছে অনেক। এত বয়স্ক লোক, তার প্রিয় খেলা হইল রেস্লিং, হা হা হা হা। আর গানের চয়েস, মাশাল্লাহ কি আর বলবো? একটা গানতো মনে হয় তুমি আর্কাইভে পাও নাই তাই না?”

“জ্বী মামুন ভাই।”

“লোকটার জীবনটা অনেক অদ্ভুত লাগছে। বয়স্কালে রাজনীতি করছে,শত শত মানুষের সাথে উঠাবসা করছে, যতদিন চাকরী করছে কি দাপটেই না ছিল। অথচ অবসরে গিয়ে বউ ছেলেপুলেদের সাথে একটা অলিখিত দুরত্ব হইয়া গেছে। কেমন একা হইয়া গেল এত প্রাণ চঞ্চল মানুষটা। আহারে, সেইদিন আমিও ভাবতেছিলাম, তার জায়গায় থাকলে আমার কি হইত। আসলে তোমার মনে হয় কপালডা খারাপ রজত। ক্লিক করলো না প্রোগ্রামটা।”

রজত চুপ করে ভাবতে থাকে, মামুন ভাই আসলে ঠিক কোন দিক থেকে ছুরিটা বসানো শুরু করবেন।

“রজত, তোমার শো টা বন্ধ হবার পর নতুন একটা শো এর প্ল্যান করা হইতেছে। আমার ইচ্ছা তুমি ঐ শোতে থাক।”

“কি শো মামুন ভাই?”

“কি যেন প্রেম ভালবাসার সমাধান জাতীয় শো। প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ভালো বলতে পারবে।যদিও তোমার ব্যাপারে ওদের অনেক আপত্তি। তুমি নাকি এখনো যুগের সাথে তাল মিলাইতে পার না। তোমার স্টাইল নাকি ওল্ড ফ্যাশন। আরো কি কি জানি বলতেছিল। বেটা একটা ছাগল। বেটা বলে কি জানো? বলে তুমি নাকি আর জে হিসেবে আনফিট কারন তুমি জান না বলিউড নায়ক রনবীর কাপুর তার শেষ মুভিতে কত পারিশ্রমিক পাইছে? বলে তোমার বাংলা উচ্চারন নাকি শান্তিনিকেতন মার্কা। আরো কি বলে জানো? বলে তোমার নাম নাকি আর যে দের সাথে যায় না। তার জন্য এখন মা বাপের দেয়া নাম বদলাইতে হবে, শালা ফাজিল কোথাকার।”

“ঠিকইতো বলছে মামুন ভাই। আমি আসলেই জানি না রনবীর কাপুর কত পারিশ্রমিক পাইছে।আর অন্য সব আর জে দের মতন সুন্দর কইরা কথাও বলতে পারি না। আমার নামটাও ক্ষেত। এটাও সত্য।”

“আরে ধুর ওগো কথা বাদ দাও। আমি তোমার নাম বইলা দিতেছি। তুমি বইসা থাক শক্ত কইরা।”

“দেখা যাক মামুন ভাই, এখনোতো সময় আছে।”

এমন সময় শফিক ঢুকল রুমে। আর রজতের দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে বললো

“রজত ভাই, একটা আট নয় বছরের টোকাই গোছের ছেলে এসেছে। আপনাকে খুঁজছে।”

“চলে এসেছে? শফিক ওকে একটু বসতে দাও আমি আসছি। মামুন ভাই, আপনার সাথে এ নিয়ে অন্য আরেকদিন কথা বলবো। এখন আমি যাই, শো এর টাইম হয়ে এলো প্রায়।”

“হ্যা তা যাও। কিন্ত পোলাডা কে? কইয়ো না যে তোমার আজকের শো এর গেস্ট ”

“হা হা হা হা মামুন ভাই, আপনার অনেক বুদ্ধি, ঠিক ধরছেন, সে আসলেই আমার আজকের শো এর গেস্ট।”

বলেই একটা মুচকি হাসি দিয়ে রজত এগিয়ে গেল অন এয়ার রুমের দিকে।

(চলবে)

No Comments

Post A Comment