Skip to toolbar
Categories

ফ্লপ শো: জনতা এক্সপ্রেস (পর্ব – ২)

ভিজিটর রুমে সোফার উপরে বসে আছে টুকু। এত্ত টুকুন একটা ছেলে। এই টুকু সোফায় তার পা ঝুলে আছে। সেও মনের আনন্দে পা দুলিয়ে যাচ্ছে। এই কনকনে শীতের মধ্য একটা হাফ প্যান্ট পরে আছে। প্যান্টের অরিজিনাল কালারটা যে কি বোঝা খুব মুশকিল। আর কমলা রঙের একটা হাফ শার্ট। মাঝখানের একটা বোতাম নেই। কাধের কাছটায় সেলাই খুলে গেছে একটু। কি যেনো খেয়ে এসেছে, এখনো মুখের কাছে লেগে আছে। একটু খেয়াল করে দেখল রজত, ছেলেটার পায়ে অনেক ধূলা লেগে আছে। আর কয়েকটা জায়গায় হাল্কা ক্ষত হয়তো। মুখটা কেমন যেন মলিন মনে হচ্ছে আজ। সেদিন যখন কথা হলো অদ্ভুত একটা দুত্যি ছিল ওর চোখে মুখে। ভরপুর আত্নবিশ্বাস। বেঁচে থাকার আনন্দের ঝিলিক।


“কেমন আছ টুকু?”

ঘুরে রজতের দিকে তাকাল, আর হাসি ফুটল তার মুখে।

“ভাল আছি”

“একা একা আসছ? ভয় লাগে নাই এত রাতে?”

“একা আসি নাই। আমার সাথে আমার ভইন আসছে। আর একা আসলেও ভয় পাইতাম না। ভইন একা একা থাকতে ভয় পাইতেছিল। তাই হেরেও নিয়া আসছি।”

“কোথায় তোমার বোন?”

“বাইরে খাড়ায় আছে।”

“আরে ওকে বাইরে দাড় করায় রাখছ কেন? ভেতরে নিয়া আস যাও।”


ফাইল খুলে বসল রজত। গোটা গোটা অক্ষরে টাইপ করা লেখা গুলোর দিকে চেয়ে আছে আনমনে। টুকুর বৃত্তান্ত লেখা। নাম বাবা মায়ের পরিচয়ের অংশ পর্যন্ত পরেই এই টুকুর মধ্যেই কলম নিয়ে একটা বৃত্ত আকলো রজত। যেন এই বৃত্তেই আটকে গেল তার চিন্তা ভাবনা।


“ভাইজান, নিয়া আসছি আমার ভইনরে। ওর নাম শম্পা”


মুখ তুলে দেখি দরজার ঠিক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে দুটো শিশু। টুকুর মুখ উজ্জ্বল। আর সাথে মিষ্টি চেহারার মেয়েটি একটু অস্বস্তি বোধ করছে। পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে কিছু সময় তার লাগবেই। তার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরো ঘরময়।


“ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এদিকে এসো।”


ভয়ে ভয়ে গুঁটি গুঁটি পায়ে এল যেন ওরা। ওদের দিকে তাকাতেই রজতের কেমন যেন অনুভুতি হচ্ছে। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ওদের দৃষ্টি কোথায় কিভাবে যেন রজতকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। শো শুরু হতে খুব বেশি দেরি নেই। সে এখন বুঝতে পারছে না কি করবে? তার ইচ্ছে ছিল টুকুর একটা সাক্ষাৎকার নেবে। টুকু তার চোখ দিয়ে এই ছোট্ট জীবনটাকে কিভাবে দেখে? সেদিন যখন ওর সাথে কথা হয়, এই অল্প বয়সে ছেলেটির হিসেব নিকেশের ক্ষিপ্রতা রজতকে মুগ্ধ করেছিল। বয়সের তুলনায় পরিনত মনস্তত্তের অন্য দিক গুলো সে খুঁজতে চেয়েছিল। এই চিন্তাভাবনার পেছনে কতটা দারিদ্র আর কতটা প্রাকৃতিক, কতটা বেড়ে উঠা আর কতটা সংগ্রাম। এই প্রশ্নের উত্তরগুলোই খুঁজতে চেয়েছিল সে। ওদের দিকে তাকাতেই বুকের কোথাও যেন চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভুত হচ্ছে। কেন সেটা জানা নেই। বাচ্চা দুটো ঠান্ডায় কাঁপছে। থেমে থেমেই ওদের দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগছে। খুব মায়া লাগছে দেখে।


“তোমরা রাতে খেয়েছ কিছু?”

“হ, পাউরুটি আর কলা খাইছি।”

“আস চল, আমরা আগে কিছু খেয়ে নিই। আমার অনেক ক্ষুধা লাগছে।”


গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতেই রজত সিদ্ধান্ত নিল দুজনকেই অন এয়ারে নিয়ে যাবে। আজকের শো হবে স্ক্রিপ্ট ছাড়া। তার হারানোর আর কিছু নাই। মনের উপর জোর খাটানোর চেয়ে এটুকু বাজী খেলা এমন কোনো ব্যাপার না। ফাইলের কাগজগুলো ছিড়ে যখন বাস্কেটে ফেলছিল তার আশে পাশের কয়েকজন কলিগ অদ্ভুতভাবে ওর দিকে দেখছিল। এখন আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না রজত। এক অদ্ভুত আত্নবিশ্বাস ঘিরে ধরেছে তাকে। কেউ হইয়তো খেয়াল করলো না। এক চিলতে হাসি ফুটেছে তার মুখে। সে এগিয়ে গিয়ে টুকু আর শম্পাকে বসিয়ে দিল। আর নিজের গায়ের চাদর খুলে ওদের গায়ে জড়িয়ে দিল।


“প্রিয় শ্রোতা বৃন্দ, প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার ঠিক রাত একটায় এক সেকেন্ডও দেরী নয়। আমি রজত হাজির হয়েছি যথারিতী আপনাদের প্রিয়ই বলেন কিংবা অপ্রিয় কিন্ত আমাদের এখন পর্যন্ত নিয়মিত শো জনতা এক্সপ্রেস নিয়ে। আর প্রতিদিনের মতন আমাদের আজকের অতিথি, ওহহো একটু ভুল হয়ে গেল। আজ আসলে একটু ব্যতিক্রম। আমাদের আজকের অতিথি দুজন। আসুন আগে ওদের সাথে পরিচিত হই।”


“আমার নাম টুকু, আর এইডা আমার ভইন। ওর নাম শম্পা। এই শম্পা তোর নাম ক। ডরের কি আছে, আমি আছি না?”

“শম্পা, আমার নাম শম্পা” খুব ক্ষীন ভয় মেশানো গলায়।


“টুকু শম্পা, শম্পা টুকু। বাহ সুন্দর নাম। তা তোমরা কোথায় থাকো? কি কর? একটু বলবা আমাদের কে?”


“উইযে একটা বস্তি আছে না? রেল লাইনের উল্টা দিকে? ওইখানে থাকি।একটা খুপড়িতে। আমি আমার ভইন আর আমাগো লগে আরেকজন থাকে। হেরে আমরা বাপ কইয়া ডাকি, তয় হেয় আমরার বাপ না।”


“তোমাদের মা বাবা কোথায়?”


“বাপরে আমরা কুনুদিন দেখি নাই, দেখতে মনে হয় আমাগো কারো মতনই হইব।মাও মইরা গেছে ছুডু বেলায়।আমরা দুই ভাই বোনরে আমাগো এই বাপই বড় করছে।আমরা কোনোদিন রাস্তায় ফুল
বেঁচি, কোনোদিন লেবু বেঁচি,আবার কোনোদিন চক্লেট। যেইদিন যেইটা থাকে। তয় শম্পা প্রায় সবদিনই ফুল বেঁচে। ও ফুল খুব ভালা পায়। তাই আমি সবসময় ওরে ফুল আইনা দিই।”

“বেলী ফুল আমার বেশি ভালা লাগে। কি সোন্দর খুশবুগো।” বলেই একটা লাজুক হাসি দেয় শম্পা।


“তোমাদের বাবা কি করেন?”

“কিছু না। হেরেতো কেউ কুনু কাম দেয় না। হেয় হইল হিজড়া। মাঝে মাঝে এর ওর থেইকা কাইড়া ট্যাকা নিয়া আসে। তয় আমাগো লাইগা হের অনেক মায়া। তাই না শম্পা।”

“হ। আমারে অনেক আদর করে। ভাইরেও করে, তয় আমারে বেশি আদর করে।”


“তোমরা স্কুলে যাও না?”

“নাহ স্কুলে পড়তে অনেক ট্যাকা লাগে। ট্যাকা দিব কেডা?”


“স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না?”

“হ মাঝে মাঝে যখন রাস্তায় দেখি আমার লাহান বাইচ্চা গুলান যাইতেছে তখন অনেক যাইতে মন চায়। তয় আমরা দুইজন ঘরে পড়ি। বাপে আমাগো লাইগা বই কিন্না আনছে। কবিতার বই।”

“হ। আমি দুইটা কবিতা কইতে পারি।”


“বলতো একটা কবিতা।”

“আম পাতা জুড়া জুড়া, মারব চাবুক চরব ঘুড়া, উম উম, ভাই এর পরে কি জানি?”
“ওরে বুবু সরে দাড়া, আসছে আমার পাগলা ঘুড়া, পাগলা ঘুড়া ক্ষেপেছে” দুইজনই একটা ভঙ্গি করল চাবুক মারার। আর একসাথে বলে উঠল
“চাবুক ছুড়ে মেরেছে”


“হা হা হা। খুব সুন্দর হইছে। আচ্ছা এখন আমরা একটা গান শুনবো। তোমরা বলো কোন গান শুনবা?”


“লাল পরী নীল পরীর গানটা,ঠিক আছে না শম্পা?”

“নাহ। আমি পড়ে না চোখের পলক গান শুনমু।” বলেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে শম্পা।


“প্রিয় শ্রোতা এখন আমরা প্লে করছি আমাদের অতিথি শম্পার পছন্দের প্রানের চেয়ে প্রিয় ছবির পড়েনা চোখের পলক আর আমার পছন্দের রেনেঁসার আজ যে শিশু। আপ্নাদের কোনো রিকোয়েস্ট থাকলে এস,এম,এস করতে পারেন যেকোনো মোবাইল থেকে ৫৮৫৮ নাম্বারে। আমাদের সাথেই থাকুন, শুনতে থাকুন জনতা এক্সপ্রেস”

একটার পর একটা প্রশ্ন করে যায় রজত। বৃষ্টি পড়লে ওরা খুপড়িতে কিভাবে থাকে? শীতের দিনে কিভাবে থাকে? শুধু একটা জিনিষ চাইতে বললে কি চাইবে? দেশের প্রধান মন্ত্রী হলে সবার আগে কোন কাজ করবে? যদি কোনোদিন তাদের বাবার সাথে দেখা হয় তাকে কি বলবে? আর প্রতি প্রশ্নের উত্তরে খুঁজে পায় জীবনের ভিন্নতর রঙ। মা বাবা হারা এটুকুন দুটো বাচ্চা বড় হচ্ছে এমন একজন মানুষের কাছে যে হয়তো কখনো সন্তানের জন্য মায়া মমতার পূর্ণাঙ্গ অনুভূতিটাই পাবে না। টুকু শম্পার বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা আর সংগ্রাম, আর তারপরেও টুকরো হাসি আনন্দ। রজত মনে মনে কল্পনা করল দৃশ্যটা একবার। টুকু শম্পা দিনের বেলায় ফুল বিক্রি করছে ট্রাফিক সিগন্যালে। এই গাড়ি ওই গাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে। আর দিন শেষে নীড়ে ফিরে ওই অপূর্ণ মানুষটার জীবনে এনে দিচ্ছে অকৃত্রিম পূর্ণতার আস্বাদ। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। স্টিভের কথা মনে পড়ে রজতের। একটা লাইফ স্টাইল ডকুমেন্টরির বই উপহার দিয়েছিল। বইয়ের প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা ছিল


প্রিয় রজত

সে ছোট বেলা থেকে দেখছি। তোমাকে যতটা দেখেছি, তার ভিত্তিতে বলছি। এটা ঠিক অনুমান নয়। বলতে পার অনুসিদ্ধান্ত। আমার এই দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে আমার দেখা অন্যতম মেধাবী সাংবাদিক হচ্ছ তুমি। কিন্ত তুমি যতটা প্রফেশনাল, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ইমোশোনাল। এই সামান্য একটা ব্যাপার তোমার ক্যারিয়ারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। আমি হলফ করে বলতে পারি, তোমার কখনই আমার মতন এত টাকা হবে না। কিন্তু বিশ্বাস কর, মনে প্রাণে আমি তোমার এই ইমোশনকে ভয়ানক শ্রদ্ধা করি। মাঝে মাঝে অনেক হিংসেও করি। একটা সারাদিন আমি বসে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছি আমার মধ্যেও এর সামান্যতম বিকাশ ঘটাতে। কেন জান? কারন তোমার এই ইমোশন তোমাকে পরিশুদ্ধ করেছে। তুমি একজন বিশুদ্ধ মানুষ। আর জীবনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো একজন ভাল মানুষ হওয়া। আমি তা হতে পারিনি। ভাল থেকো, যদিও জানি এটা তোমার জন্য অনেক কঠিন হবে।

স্টিভ


“তোমাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ টুকু আর শম্পা। প্রিয় শ্রোতা, আজকে সময় ফুরিয়ে এল। কেমন লাগলো জানিয়ে এস,এম,এস করতে পারেন শুরুতে জনতা এক্সপ্রেস লিখে স্পেস দিয়ে মন্তব্য লিখে পাঠিয়ে দিন ৫৮৫৮ নাম্বারে। আর একটা বিশেষ ঘোষনা, আগামী মঙ্গলবার, আমাদের গৌরবময় বিজয়ের মাসে আপনাদের সাথে শেষবারের মতন জনতা এক্সপ্রেস নিয়ে আসব আমি রজত। আর শেষ পর্বে আমাদের অতিথি কে হবে? কে হবে? এনি গ্যাস? হা হা হা। যা হোক কষ্ট করতে হবে না আপনাদের। আমিই বলে দিচ্ছি। শেষ পর্বে চমক হিসেবে আমি নিজেই অতিথি হিসেবে হাজির থাকব। আপনাদের যদি আমার কাছে কোনো প্রশ্ন থাকে সেটাও একি ভাবে এস,এম,এস করতে পারেন। ততদিন পর্যন্ত ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। বিদায়, আলবিদা, টাটা।”


(আগামী পর্বে সমাপ্য)

No Comments

Post A Comment