Skip to toolbar
Categories

যাপিত জীবন – ৩

চাকুরীজীবিদের সাপ্তাহিক সকালগুলো সাধারনত খুব দ্রুত গতির হয়। দ্রুত বিছানা ছাড়া, ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ব্যস্ত শহরের রাস্তায় নেমে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর পরে আর ধীরে চলার কোনো সুযোগ থাকে না। শহুরে জীবনের চিত্র আঁকতে গেলে তাই লাইনের সারি এসে পরে তুলির আঁচড়ে। মুহুর্ত ধরে রাখা যায় না কোনো ভাবেই। অথবা মুহুর্ত ধরে রাখার মানসিকতাটাই হারিয়ে যায় ব্যস্ততার ভিড়ে। তবে আমার সাপ্তাহিক দিন গুলোর শুরুটা একটু আলাদা হয়। বাসা অফিসের খুব কাছাকাছি হওয়াতে আমি যতটা সম্ভব দেরীতে বিছানা ছাড়ি। ব্রেকফাস্ট করা হয়না কখনই, ঘুমের ক্লান্তি থাকলে রিক্সার খোঁজে গিঞ্জি গলি ধরে হাঁটতে থাকি। আর নয়তো হাঁটতে হাঁটতেই পৌছে যাই অফিসে। আর শুরু হয় ক্লান্তিহীন ব্যস্তদিন। আজকেও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই।

প্রচন্ড ব্যস্ত দিন যাচ্ছে অফিসে। মিটিং রুমে রুদ্ধশ্বাস সময় কাটছে। একটার পর একটা কাজ শেষ করেও পেরে উঠা যাচ্ছে না। সাথে নিত্ত্য নৈমত্তিক ঝামেলার টানা হেচড়া, বসের ঝাড়ি, সব কিছু সামলে নিয়ে আজকের দিনের কাজ করার সব উৎসাহের নেপথ্যে পরের তিন দিনের টানা ছুটি। অফিসে সময় কোন দিক দিয়ে পালায়, কেউ টের পায় না। কাজ গুছিয়ে ঠিক নয়, ক্লান্তির কারনে যখন মনে হলো আজকের মতন দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাব, তাকিয়ে দেখি অফিসে কেউ নেই। আমি একাই বসে আছি। গার্ডটা একটু পর পর এসে দেখে যাচ্ছে, আমি কখন ব্যাগ গোছাবো। সময় রাত ৯টা। ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই পুরোনো শত্রু ব্যাক পেইনটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। পাত্তা না দেয়ার অসম্ভব চেষ্টাটাকে সার্থক করে ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে নেমে আসছি। কি ভাবছি না ভাবছি, নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মাথায় শুধু টিক টক টিক টক শব্দ।

নিচে নেমে আসতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। অদ্ভুত ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। ঢাকার বৃষ্টির কোনো ক্লাস নেই। এই নামে, দুই তিন ফোঁটা পড়েই খালাস। তবে আজ ঝুম বৃষ্টি। সাথে ঠান্ডা বাতাসের ছাঁচ। হাত বাড়িয়ে একটু ছুঁয়ে দিয়েই ভেজা হাতে মুখ ভিজিয়ে নেয়া, এটা বোধকরি খুব নাটকিয় নয় আমাদের জন্য। এত রাতে বৃষ্টির মধ্যে রিক্সা পাবার কোনো কারন নেই। আবার ভিজে ভিজে বাসায় যাব সেটাও একটু চিন্তার বিষয়। জামা কাপড় নয় ঠিক, বরং ল্যাপটপ আর মোবাইলটা নিয়েই সব দুশ্চিন্তা। হুট করে মনে পড়ে গেল সেদিন রেইনকোটটা ফেলে রেখে গিয়েছিলাম অফিসে। ব্যস হয়ে গেল দারুন সমাধান। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দে কানে হেডফোন গুজে গান বাজিয়ে দিলাম। আহ, কি অদ্ভুত। সময়ের বৈপরিত্ত্য থাকলেও প্লে লিস্টে থাকা অঞ্জন দত্তই সবার আগে মন ভোলানো কন্ঠে গেয়ে উঠলেন

একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে
থাকবে না সাথে কোনো ছাতা
শুধু দেখা হয়ে যাবে মাঝ রাস্তায়
ভিজে যাবে চটি জামা মাথা
থাকবেনা রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া
দোকান পাঠ সব বন্ধ
শুধু তোমার আমার হৃদয়ে
ভিজে মাটির সোদা গন্ধ।

বাসায় ফিরে চেঞ্জ করে ডিনার করতে করতে আরো সময় পেরিয়ে গেল। শরীরের প্রতিটা কণায় যেন ক্লান্তি ভর করেছে। বিছানা থেকে কিছুটাক্ষন দুরেই রইলাম। হুট করে ঘুমিয়ে পড়ার ভয়ে। রাত ১০ টা। কোনো কিছুতেই ঠিক মন বসছে না। টিভি বন্ধ করে দিলাম। ল্যাপটপটা চালুই আছে। ফেসবুকের পেইজটা একটু পর পর নিজে নিজেই সবার আপডেট খুঁজে নিচ্ছে। আমার সেদিকে মন নেই। হাতের কাছেই হুমায়ুন আহমেদ। তাই পড়ছি মন দিয়ে। মোবাইলটা ক্রমাগত বিরক্ত করছে। কিভাবে যে সবাইকে বলি, আমার আসলেই আজ কাল ফোন ধরতে ইচ্ছে করে না। আর যা ইচ্ছে করে না, সেটা জোর করে করার মনটাকে আমি নিজেই সেই কবে গলা টিপে মেরে ফেলেছি। নতুন কেনা স্মার্ট ফোনটা আগের সস্তার নোকিয়ার মতন চার্জ থাকে না। তাই রোজ চার্জ দেয়ার ক্লান্তিকর কাজটা করতে গিয়ে মোবাইলটা হাতে নিতেই তারিখটা চোখে পড়ল। ২২শে মে, ২০১৩।

আজ আমার জীবনের ২৯ বছর ৩৬৪ তম দিন পার করছি। কাল ২৩ শে মে। আমার ত্রিশতম জন্মদিন। খুব কি অন্যরকম অনুভূতিময় কোনো ব্যাপার? অনেক ভাবার চেষ্টা করলাম। আমার একজন প্রিয় শিক্ষক, তার ত্রিশ তম জন্মদিনে খুবই কাতর হয়ে পড়লেন। বয়সটা আর ২ দিয়ে শুরু হবে না বলে। উনি নাকি দুই রাত ঠিক মতন ঘুমোতে পারননি এই চিন্তায়। তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এরকম করার কারনটা। আজও যে খুব ভালো বুঝতে পারলাম তাও নয়। তবে বয়সটা ২ দিয়ে শুরু হওয়া আর ৩ দিয়ে শুরু হবার মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য থেকেও থাকে, সেটা যে আমাদের নিজেদের তৈরী করা এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সেই বোধের কারনেই হয়তো ত্রিশের আলাদা কোনো পার্থক্য নেই। তবে একেবারেই কোনো পার্থক্য নেই এটা বললে আসলেই ভুল বলা হবে। দুই তিন বছর আগেও দুই দিনের ছুটিতেই প্রতি মাসে একটা করে ট্যুর দিতাম। আর এখন ছুটির দিনে সকালে উঠতে হবে এটা ভাবতেই পারি না। সপ্তাহান্তে একবার করে ক্যামেরার লেন্সটা পরিষ্কার করি, অথচ মাসে একবারও ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বের হয়ে উঠা হয় না। এটা সেটা মিলিয়ে মাথায় কত কিছু ঘুরতেই থাকে। কত কত আইডিয়া, প্লট, ভাবনা কিংবা মনের কোনায় জমে থাকা অসংখ্য কথা। লেখা আগায় না। শরীরে একটা ক্লান্তি বাসা বাধতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। ত্রিশের মাহাত্ন্যটা হয়তো এখানেই।

রাত এগোতে থাকে। আমি ইতিমধ্যে হুমায়ুন ছেড়ে ল্যাপটপ, টিভিতে সময় পার করতে লাগলাম। রাতের এই সময়টাতে যদি না মুভি দেখি, অবশ্যই গান শুনি। এটা অবশ্য খুব অল্প দিনের অভ্যেস। গানের কালেকশন খুব বেশি নেই। হাতে গোনা অল্প কিছু গানই ঘুরে ফিরে বাজে। অর্নবের “তোমার জন্য নিলচে তারার” শেষ হতেই শাহানা সুমধুর কন্ঠে গেয়ে উঠল,

আমার নিশিথ রাতের বাদল ধারা
আমার নিশিথ রাতের বাদল ধারা
এসো হে গোপনে, আমার স্বপ্ন লোকের দিশাহারা
নিশিথ রাতের বাদল ধারা
আমার নিশিথ রাতের বাদল ধারা

বাইরে বৃষ্টি বেয়াড়া আচরন করছে। বেড়েই চলেছে। জানালার কাঁচটা সরিয়ে দিলাম। বৃষ্টির স্পর্শে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পাশের বাড়িতে ছোট ছেলেটা বারান্দার রেলিং এ দাঁড়িয়ে বৃষ্টির সাথে খেলছে। ভেতর থেকে বাচ্চাটার মা চিৎকার করে ডেকেই যাচ্ছে। প্রায় রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে প্রেমিকার সাথে কথা বলা ছেলেটি আজ কোথায় আশ্রয় নিয়েছে জানি না। রিক্সা গুলো ক্রমাগত টুং টাং বেল বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে। উপরের তলার ভদ্র লোক আজ সিগারেট খেতে ব্যালকনিতে আসতে পারেনি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার বাসার উল্টো পাশে ভুতের বাড়ি থেকে ভুতটা পালিয়ে গেছে। এখন সব ফ্ল্যাটে আলো ঝলমল করছে। স্ট্রীট লাইটের আলোতে লেকের পানিতে বৃষ্টির আনাগোনা। মনে হলো অনেকদিন জানালা দিয়ে আমার পৃথিবীটাও দেখা হয় না। কানে বাজছে অঞ্জন দত্ত, আহ!!! আমার জানালা,

আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়
একটু বর্ষা, একটু গ্রীষ্ম, একটু খানি শীত
সেই একটু খানি চৌকো ছবি আকড়ে ধরে রাখি
আমার জানলা দিয়ে আমার পৃথিবী।

সেই পৃথিবীতে বিকেলের রং হেমন্তে হলুদ
সেই পৃথিবীতে পাশের বাড়ির কান্না শোনা যায়
পৃথিবীটা বড়ই ছো্ট আমার জানালায়
আমার জানলা দিয়ে আমার পৃথিবী।

একটু আগে তরতাজা হুমায়ুনের যেই বইটা পড়লাম সেটাতে প্রবল জোছনা ছিল। হুমায়ুন রন্দ্রে রন্দ্রে ঢুকে আছে আমাদের। তাই সব সময়ের অনেক বেশি বৃষ্টি বিলাসী আমিও হুট করে জোছনাকে মিস করতে শুরু করলাম। মনে পড়ল, কাল বৌদ্ধ পূর্ণিমা। ইশ, আজকের চাঁদটা না জানি কি অদ্ভুত। ঠিক এই এরকম কোনো এক অদ্ভুত রাতে চাঁদের ছটায় হয়তো পুরো পৃথিবীকে এক পাশে রেখে জীবনটাকেই নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। আজকের এই বৃষ্টি রাতে প্রথমবারের মতন বৃষ্টি থামার প্রার্থনায় কিংবা চাঁদের প্রতীক্ষায়, রাত এগোতে থাকে আপন গতিতে। উচ্ছ্বাস নেই, উল্লাশ নেই, শান্ত পরিমিত। রাত ১২ টা ১ মিনিট। মোবাইলে ম্যাসেজ আর ফোন আসতে শুরু করেছে, ফেসবুকের পেইজ জুড়ে পরিচিত অপরিচিতদের আনাগোনা।

ত্রিশের অপরিচিত ভুবনে আমাকে স্বাগতম।

No Comments

Post A Comment