Skip to toolbar
Categories

জীবিকা

আজ সকাল সকাল প্রচন্ড রোদ পড়েছে। মাত্র ৮ টা বাজে। তাতেই রোদের জন্য তাকানো যাচ্ছে না। রইস উদ্দীনের চোখ দুটো এমনিতেই ছোট। ছেলেবেলায় সবাই তাকে চাইনিজ বলে ক্ষ্যাপাতো। রোদেলা দিনে চোখদুটো এত ছোট হয়ে যায় যে মাঝে মাঝে সে ভাবে এখনতো তাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না। হাতের খামটা মুখের সামনে ধরে হাঁটছে রইস। কিছুদূর এগোতেই তার চোখে পড়ল। বিশাল ভবনটা। নিচ থেকে উপরে একবার তাকাতেই অনেক সময় লেগে যায়। ছোট বেলায় একটু বড় বিল্ডিং দেখলেই গুনতে ইচ্ছে করত কয়তলা। কিন্ত এই ভবনটা গুনে শেষ করা রইসের পক্ষে সম্ভব না। ৫-৬ তলা বিল্ডিং হলেই প্যাঁচ লেগে যায়। আর এইটাতো বিশাল। একপা একপা করে রইস যতই এগুতে থাকে অর বুক ধড়ফড় বাড়তে থাকে। এত উঁচু। মাথা ঘুরতে থাকে রইসের।


আজ তার কাজের প্রথম দিন। রইসের চাচা অনেক দেন দরবার করে কাজটা জোগাড় করে দিয়েছে। কাজটা শুনে প্রথমে কিছুতেই করতে রাজি হয়নি রইস। কিন্ত কোনো উপায় ছিল না তার। এমনিতেই একটু চুপচাপ ধরনের সে। তার উপর বাবা মারা যাবার পর মেরুদন্ডটা আরো দুবর্ল হয়ে গেল। তাই চাচা এসে যখন গলা ভারী করে চাকরীর কথা বললো, না বলার মতন কোনো উপায় তার হাতে ছিল না।


“কিরে রইস পারবি না ?”


“জ্বী চাচা অবশ্যই পারবো। পারতে আমারে হবেই। নইলে চলবে কেমনে কন? ”


“শাবাস বেটা। এইতো চাই। তাইলে তুই সব গোছ গাছ কইরা নে। সামনের বুধবার যেতে হবে।”


চাচাকে ভয়ের কথাটা মুখ ফুটে বলা হয় নাই আরেকটা অজানা ভয়ে। একবার যদি চাচা ক্ষেপে যায় তাহলে অনেক সমস্যা হয়ে যাবে। এইটুকু বোঝার মতন বয়স রইসের হয়েছে। কিন্ত তারপরো চাইলেইতো আর ভয় দূর করা যায় না। নিচ থেকে দেখেই গলা শুকিয়ে আসছে। উপর থেকে একবার নিচে তাকালে না জানি কেমন লাগবে?


“কি ব্যাপার রইস মিয়া? আইজকা তোমার প্রত্থম দিন। আর আইজকাই তুমি দেরি কইরা আসলা? এমন করলেতো চাকরী টিকায় রাখতে পারবা না।”


কি বলবে ভেবে পায় না রইস। চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ভয়ে তার পা কাপঁছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।


“কি হইল? দেরী কইরা আসছ। আর এখন দেহি নড় না জায়গা থেইকা। এইভাবে করলে চলবো কেমনে? আস, আমার পিছে পিছে আস।”


আগে কখনো লিফট দেখেনি রইস। লিফট বস্তটা কি এখনো ঠিক মতন বুঝতেই পারছে না। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। রইসরা যাবে বিল্ডিং এর ছাদে। যেই বিল্ডিং এর নিচ থেকে উপর পযর্ন্ত তাকাতেই ঘাড় ব্যথা হয়ে যায় সেই বিল্ডিং এর ছাদ পযর্ন্ত হেঁটে উঠতে পায়ের কি দশা হবে কে জানে? অজানা আশংকা নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে রইস।


“কই রইস মিয়া। নাও শুরু কর। এইটা কোমরে বাইন্ধা নাও।”


জিনিষটা হাতে নিয়ে একবার উঁকি দিয়ে নিচের দিকে তাকালো সে। সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল যেন। নিচ থেকে বুঝাই যায়নি আসলে বিল্ডিংটা কতটা উচু। কাপূনি বাড়তে লাগলো।


“তুই মি এইটা পড়তে জান? নাকি পরাইয়া দেওন লাগবো?”


“এইটা কেমনে পরে আমি জানি না।”


“সেইটা আগে কইবা না। খালি খালি দেরি করাও। তোমারে নিয়া কেমেনে যে কাম করমু এটাই বুঝি না। আস এইদিকে আস। আমি পরাইয়া দিই।”


রইসের মন বসে না। লোকটা কি কি জানি করছে। রইস তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। অনেক ভয় করছে রইসের। এমনিতেই সে ভিতু প্রকৃতির ছেলে। ছেলে বেলায় কিছু হলেই তার কান্না পেত। লুকিয়ে লুকিয়ে কাদঁত। কারন তার বাবা বলেছিল ছেলেদের কাঁদতে হয় না।


“ও কি রইস, বাপ কান্দ কেন? বেটা ছেলেগো কাঁদতে হয় না বাপ। লোকে মন্দ কবে নে। চোখ মুছ।”


রইসের চোখ টলটল করছে বাবার কথা মনে করে। বাবা থাকলে আজ তাও একটু ভরসা দিতে পারত। কিংবা হয়তো বাবা থাকলে তাকে আজ এইখানে এই ভয়ংকর কাজই করতে হতো না।


“নাও হইয়া গেছে রইস মিয়া। চল, এইবার আল্লার নাম নিয়া শুরু কইরা দেও। আগে কইয়া দিই। ঝুপ কইরা নামবা না। তাইলে কইলাম ভাংচুর হইয়া যাইতে পারে। পাওটারে শক্ত রাখবা। হাত দুইটা হইল তোমার আসল জিনিষ। এই দুইটা দিয়া তোমার কাম করতে হইব। তাই সবচাইতে যেইটা বেশি দরকার তা হইল এই যন্ত্রের উপর ভরসা করা। এর উপর ভরসা করতে না পারলে কাম ঠিক মতন হইব না। বুঝতে পারছ কি কইলাম?”


“জ্বী বুঝতে পারছি।”


“তোমারে দেইখাতো মনে হইতাছে অনেক ভয় পাইতাছ।”


“না না ভয়ের কি আছে। বেটা ছেলের আবার ভয় কিসের?”


“ভয় না লাগলেই ভালো।”


এটা বলেই লোকটা তর তর করে নিচে নেমে গেল। ভয়টা কেমন যেন কমে আসছে আস্তে আস্তে। বাবা যেন অনেক দূর থেকে বলছে


“বেটা ভয়ের কি আছে? একদম ভয় করবি না। বেটা ছেলের ভয় কি?”


মায়ের মুখটা ভাসছে চোখের সামনে।


“আমার জন্যি দোয়া কর মা।”


পুরো শহরের দিকে পেছন ঘুরে শহরের সবচাইতে উঁচু দালানের ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে রইস । শহরের সবচাইতে আভিজাত হোটেলের গ্লাস ক্লিনার।

No Comments

Post A Comment