Skip to toolbar
Categories

অন্ধকারের গান অথবা একটি নিছক সাদাকালো ভালোবাসার গল্প

এক

প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, ঠান্ডায় যুবু থুবু হয়ে। গায়ে মাথায় চাদর-কম্বল যার যা আছে। কনকনে ঠান্ডায় আরামের ঘুম। বগিটা প্রায় খালি, সবাই একটা পুরো সিটে শুয়ে আছে। আমার সামনের সিটেই রতন, পাশেই রনবীর। আরো কয়েকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক সেদিক। আমি উঠে গিয়ে আলাদা একটা সিটে বসলাম। আসে পাশে কেউ নেই। সিটের পাশের জানালাটা খুলে দিলাম। একটা গাঁঢ় শীতল অনুভূতি যেন বয়ে গেল প্রতিটি শিরা উপশিরা দিয়ে। আমি চোখ বন্ধ করে এই অনুভূতি নিতে লাগলাম। চোখ খুলে বাইরের অন্ধকার দেখতে লাগলাম। অদ্ভুত ব্যাপার, যে পরিমান ঠান্ডা পড়ছে বাইরে জমিয়ে কুয়াশা থাকার কথা। চারপাশটা একেবারে স্বচ্ছ্ব। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে কোটি কোটি তারা। আর এক ফালি চাদঁ। এরকম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগে। ট্রেনের বাতিটা নেভানো থাকলে বেশ হতো।

“এই যে ভাইজান জানালাটা একটু বন্ধ কইরা দেন। অনেক ঠান্ডা লাগতাছে। ”


আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি পেছনে একজন শুয়ে আছে। এতক্ষন চোখে পড়েনি। তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিলাম। একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। যদিও এটা এমন কোনো বড় অপরাধ হয়নি। লজ্জাটা আরেকটু বাড়ল যখন শুনলাম


“ভাইজান আপনার শরীরের চর্বিতো বেজায় গরম। এতক্ষন এইভাবে বইসা ছিলেন কেমনে? ”


“দুঃখিত ভাই। কিছু মনে করবেন না। আপনি ঘুমান। ”

এতক্ষন আকাশ দেখে সময় কাটছিল। এভাবে বসে বসে সময় কাটানো মুশকিল। হ্যান্ড ব্যাগে একটা বই আছে। বইটা খুলে হাতে নিতে নিতে কানে হ্যাডফোন লাগালাম। এফ,এম রেডিওর রাতের আয়োজন শুনবো বলে। ভালোই সময় কাটানো যায়। বইটার কতটুকু পড়েছি খুজঁতে লাগলাম। পড়ে পড়ে মনে করতে হবে। তবে ছাব্বিশ পৃষ্টার আসে পাশেই হবে।

……… চাঁদের আলো যখন সমুদ্রের নোনা পানির উপর পড়ে, একটা অদ্ভুত আলো সৃষ্টি হয়। প্রতিটি ঢেউ বয়ে নিয়ে আসে সেই আলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হবে মিষ্টি একটা আলোর মিছিল। এর সাথে ঝির ঝির বাতাসের শব্দ আর সমুদ্রের স্বভাব সুলভ চাপা গর্জন। বিশালতার খুব কাছাকাছি এসে এই সৌন্দর্য অনুভব করতে হয়।………………

“প্রিয় শ্রোতা বন্ধু আমি আর, যে আহাদ রয়েছি আপনাদের সাথে রাত জাগা ভালোবাসা নিয়ে… চলে যাচ্ছি পরের এস, এম, এস এ। অবনী লিখেছেন……সেই রাতে তোমার কাধেঁ মাথা রেখে পার করা মুহুর্ত গুলো, এখনো ভোরের মিষ্টি আলোর মতন ছুয়েঁ যায় আমার চিবুক। এখনো তোমায় ভালোবাসি সেই আগের মতই। দেবে কি আমায় তুমি এতটুকু আশ্রয়………প্রিয় অবনী, আপনার ভালোবাসার মানুষের আশ্রয়ে নিরাপদ থাকুন। সার্থক হোক আপনার ভালোবাসা। এই কামনাই করছি আর আপনার জন্য এখন প্লে করছি সুমন চট্টোপাধ্যায়ের অমরত্বের গান। ”


অমরত্বের প্রত্যাশা নেই নেই কোনো দাবী দাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া
…………………………………………………
যতবার তুমি জননী হয়েছো ততবার আমি পিতা
কত সন্তান জ্বালালো প্রেয়শী তোমার আমার চিতা


অবনীদের বাড়ির ছাদটা অনেক সুন্দর। চারপাশ ঘেরা ফুলগাছের মাঝে সুন্দর একটা ছোটখাট দোলনা। সেই দোলনায় আমি আর অবনী। ও আমার একটা হাত জড়িয়ে ধরে কাধেঁ মাথা রেখে চুপচাপ বসে ছিল, একটা দীর্ঘ সময়। বাতাসের দোলায় গাছের পাতার ঝির ঝির শব্দ, পোষা পাখীগুলোর কিচির মিচির কিংবা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, গাঢ়ঁ নিস্তব্দতায় এই ছিল একমাত্র সম্বল। আর রাতের অন্ধকারে আলো হয়েছিল পূর্ণিমার চাদঁ। আমিও কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেই অনুভূতিটা এখনো আমায় ছুঁয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলেই বাতাসের ঝাপ্টায় ওর খোলা চুল আমার চোখে মুখে এসে পড়ে।


“অবনী একটা জোকস্‌ শুনবে? ”


“জোকস্‌? এটা কি জোকস শোনানোর সময়। এমন পরিবেশে বুঝি কেউ জোকস বলে? ”


“জোকস বলার জন্য আবার পরিবেশ লাগে বুঝি? ”


“হমম্‌ লাগে। ভুলেও তুমি এখন জোকস্‌ বলার চেষ্টা করবে না। ”


“আহা শোনোইনা। মজা পাবে। একবার এক ভদ্রলোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ”


“থামো। আর একটা কথাও বলবে না। বিরক্তিকর। যদি পরিবেশের মোহনীয়তা বুঝতেই না পার তবে দয়া করে বিরক্ত করো না। চুপ করে থাকো। তাও অনেক ভালো। ”


আমি রাগ করি না। মুচকি হাসি। অবনীকে রাগানোর জন্যি এসব করতাম। ও রেগে গেলে বেশ লাগতো। আর তারপর রাগ ভাঙানর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, মাঝে মাঝে সুরে বেসুরে

আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্ক ভাগী
আমি সকল দাগের হব দাগী কলঙ্ক ভাগী।


“এই শুনছ? কৌশিক……তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে? কৌশিক………উঠো কৌ………… শি………… ক”


দুই

ট্রেনের ক্যান্টিনটা বেশ চমৎকার। ঝকঝক করছে। টেবিল গুলো সাজানো গোছানো। একটা স্ট্রে আছে, একটা সুন্দর পেপার ওয়েট। ক্যান্টিনের টেবিলে পেপার ওয়েট কি কাজে আসবে ঠিক মাথায় ঢুকছে না। সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম ডেস্ক ক্যালেন্ডারটা দেখে। ‘রহ্‌মতিয়া আলেয়া সুন্নতী………মাদ্রাসা’ র একটা ডেস্ক ক্যালেন্ডার। তবে মজার ব্যাপার ক্যালেন্ডারটা ওলোট পালোট করা। এটা ডিসেম্বর মাস। কিন্ত এখানে দেখাচ্ছে সেপ্টেম্বর। বোধহয় কেউ উলটে রেখে গেছে, ঠিক করা হয়নি। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তারিখ দেখতে লাগলাম। ছুটির দিনের তারিখ গুলো লাল রঙ করা। হঠাৎ দেখলাম, সেপ্টেম্বর ১২ তারিখ। এটা যে কেন লাল বুঝতে পারলাম না। কোনো সরকারী ছুটি কি আছে সেই দিন? সেপ্টেম্বর ১২, অবনীতা’র জন্মদিন। বিশেষ একটা দিন আমার জন্যে। এখনো মনে পড়ে সেই দিনটির কথা, তখনো মুখ ফুটে বলা হয়নি মনের অনেক কথা। শুধু বুঝতে পারতাম, দুজনেই দুজনকে।

“আচ্ছা তুমি কি কিছু ভুলে যাচ্ছ ? আমাকে কি তোমার আজ কিছু বলার কথা? ”


“তোমাকে ? ওহ্‌ মনে পড়েছে। তোমাকে আমার এক বন্ধুর গল্প বলার কথা। আচ্ছা আমার মনে পড়ছে না। আমি কি তোমাকে আমার সেই বন্ধুর কথা বলেছি? ওই যে, একটা মেয়েকে পছন্দ করে কিন্তু বলতে পারে না। ”


“নাহ্‌। ”


“সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো মেয়েটাও ছেলেটাকে পছন্দ করত। যে কোনো কারনেই হোক তারা বলতে পারেনি একে অপরকে। তাদের ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা। এক সময় মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়। আর তারপর শুরু হয় কোলাহলের মাঝে তাদের ভয়ংকর একাকিত্বের এক করুন গল্প। কি যে ভয়ংকর কষ্ট। একটু প্রাণ খুলে কাদাঁর ফুসরতো পেত না মেয়েটা। আর অন্যদিকে ওই প্রাণ চঞ্চল ছেলেটা একেবারে নিষ্প্রাণ হয়ে গেলো। সারাক্ষন মন মরা হয়ে থাকে। ঠিক মতন কথা বলে না। তার কোনো কিছুই ঠিক আগের মতন নেই। খুব কষ্ট লাগে ওদের দেখলে।”

অবনীতা’র মন খারাপ হয়ে গেলো। সে একেবারে চুপ মেরে গেলো। আমি বুঝতে পারিনি ওর এতটা মন খারাপ হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে এখুনি কাদঁতে শুরু করবে।


“অবনী…”


“হম্‌ম। ”


“শুভ জন্মদিন। এই নাও তোমার উপহার। লাল টকটকে গোলাপ। ”


সে আমার দিকে তাকিয়ে ক্ষানিকটা হাসার চেষ্টা করলো। হঠাৎ আমার হাতের অন্য গোলাপটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করলো


“দুটো গোলাপ নিয়ে এলে, কিন্ত আমাকে দিচ্ছ একটা ? বাকি গোলাপ কার জন্য? ”


“বাকিটা আমার জন্য। ”


“বাকি গোলাপ তোমার মানে ঠিক বুঝলাম না? ”


“মানে শুনতে চাও? ”


“হম্‌ম চাই। গ্রহন যোগ্য মানে। ”


“দুটো গোলাপ মানে হলো আমি ধরে নিলাম আমার জীবনটা সমান দুই ভাগে বিভক্ত। একটা গোলাপ তোমায় দিলাম, এর মানে হলো আমার জীবনের অর্ধেকটাতে তোমার প্রবেশাধিকার। ”


“আর বাকী অর্ধেকটা কার? ”


“বাকী অর্ধেকটাতে কি আর সবাইকে আসতে দেয়া যায়। ”


ও তখন মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। আমি এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ক্ষানিক পরে ও ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো। আমি ওবাক হয়ে দেখলাম ওর চোখে জল। চোখ মুছতে মুছতে সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো


“যদি বলি আমি তোমাকে ভালোবাসি তাহলে কি আমায় ওই গোলাপটা দেয়া যায়? ”


আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কপালে আলতো করে চুমু খেলাম। ওর চোখ জোড়া বন্ধ। গোলাপটা ওর খোঁপায় গুজেঁ দিলাম। ১২ই সেপ্টেম্বর। এর আগে পরে অনেকবার এসেছে আমার জীবনে। এতটা অসাধারন কোনোটাই ছিল না।

No Comments

Post A Comment